হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু বুধবার, আত্মশুদ্ধি ও বিশ্বমুসলিমের মিলনমেলা

New-Project-15.jpg

হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু বুধবার

২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ

চারিদিকে তাকালে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ সাদা কাপড়ে মোড়ানো, কেউ চোখে অশ্রু, কেউ বা নিরব ভক্তিতে মগ্ন। সময়টা হজ—ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম, যা শুরু হতে যাচ্ছে ৪ জুন ২০২৫, ৮ জিলহজ ১৪৪৬ হিজরি থেকে। এই বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশে অংশ নিতে ইতোমধ্যে সৌদি আরবে জড়ো হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রায় ২০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বাংলাদেশ থেকেও এবার ৮৭ হাজার ১০০ জন হাজী হজ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র ভূমিতে অবস্থান করছেন।

কিন্তু হজ মানে শুধু ভ্রমণ নয়, এটি এক মহান আত্মত্যাগ, আত্মসংযম এবং বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও শুদ্ধতার প্রতীক। বিশ্লেষকরা বলছেন, হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার এই মুহূর্তেই সময় এসেছে বুঝে নেয়ার—এই রীতি কীভাবে ধর্মীয় অনুশীলন ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও আধুনিক মুসলিম পরিচয়ের ওপর প্রভাব ফেলে।

আনুষ্ঠানিকতা ও আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপট

হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় ৮ জিলহজ, যেদিন হাজীরা মক্কা থেকে মিনায় গমন করেন। এরপর আরাফার ময়দানে অবস্থান, মুজদালিফায় রাত যাপন, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, পশু কোরবানি ও তাওয়াফ—এই ধারাবাহিক আনুষ্ঠানিকতা চলে ৫-৬ দিনব্যাপী।

এই প্রতিটি পর্বে রয়েছে প্রতীকী ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। যেমন আরাফার ময়দানকে বলা হয় ‘হজের মূল দিন’। এখানে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের খুতবা প্রদান করেন, যা ছিল মানবাধিকারের প্রথম ঘোষণা হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশি হাজী মোহাম্মদ ফারুক হোসেন মক্কা থেকে জানালেন, “এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। মনে হচ্ছে, সব পাপ মুছে যাচ্ছে। এই একটা সপ্তাহের জন্য আমি নিজেকে শুধু আল্লাহর বান্দা হিসেবে দেখতে চাই—জাতীয়তা, পেশা, পরিচয় সব ছেঁড়ে।”

হজ ও আধুনিক বিশ্ব: একটি সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জ

বিশ্বায়নের এই যুগে হজ শুধু ধর্মীয় পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি বৈশ্বিক সমাবেশ, যেখানে বিভিন্ন জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মানুষ একত্রিত হন। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার জন্য সৌদি আরবও নিয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এবার ৩ লাখের বেশি নিরাপত্তাকর্মী, চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক ও প্রশাসনিক কর্মী হজ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকবেন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, হজ এখন একটি ‘মেগা ইভেন্ট’—এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, পর্যটন শিল্প, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়রুল বাশার বলেন, “হজ ইসলামের একমাত্র স্তম্ভ যেখানে সম্পদ ও সক্ষমতা একটি শর্ত। এটি ধনী মুসলিমদের জন্য যেমন ইবাদত, তেমনি সৌদি অর্থনীতির জন্য এটি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস।”

বাংলাদেশি হাজীদের অভিজ্ঞতা: সংকট ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজীরা সাধারনত সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যবস্থাপনাতেই হজ করেন। কিন্তু প্রতি বছরই অভিযোগ ওঠে আবাসন সমস্যা, গাইডের অভাব, সঠিক তথ্য না পাওয়া, কিংবা খাবার নিয়ে হয়রানির।

এ বছর বাংলাদেশের হজ অফিস বলছে, সৌদি সরকারের অনলাইন হজ প্ল্যাটফর্ম “নুসুক”-এর মাধ্যমে হাজীদের অনেক জটিলতা হ্রাস পেয়েছে। তবুও সবার জন্য প্রযুক্তি সেবায় অভ্যস্ত হওয়া এখনো চ্যালেঞ্জ।

বেসরকারি হাজী গ্রুপের প্রতিনিধি সালেহ আহমেদ বলেন, “প্রযুক্তি অনেকটা সাহায্য করছে, কিন্তু অনেকে এখনো কিউআর কোড বা অ্যাপ ব্যবহারে পারদর্শী না। এর ফলে মসজিদে হারিয়ে যাওয়া বা গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটছে।”

হজের মাহাত্ম্য শুধু আত্মশুদ্ধিতেই নয়, বরং এটি সামাজিক বৈষম্য ও অহংকার বর্জনের শিক্ষা দেয়। একসাথে কোটি মানুষ একই পোশাকে, একই স্থানে, একই নিয়মে আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়—এ এক বৈপ্লবিক সামাজিক বার্তা।

বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েন, মুসলিম বিশ্বের বিভাজন, যুদ্ধ ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে হজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইসলামের মূল দর্শন—ঐক্য, সহনশীলতা ও মানবতা।

৪ জুন থেকে শুরু হতে যাওয়া এই হজের আনুষ্ঠানিকতা শুধুমাত্র ধার্মিক ব্যক্তির জন্য নয়, বরং এটি পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি আত্মপর্যালোচনার সময়। একদিকে ব্যক্তিগত পাপ মোচনের সুযোগ, অন্যদিকে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য গঠনের সম্ভাবনা—এই দুয়ের সম্মিলনে হজ আজও জীবন্ত, প্রাসঙ্গিক এবং চিরন্তন।

এই হজ মৌসুমে বিশ্ববাসীর প্রার্থনা হোক—শান্তি, সহমর্মিতা ও সত্যিকারের ইসলামী মূল্যবোধের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

Leave a Reply

scroll to top