শিল্প মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারও কারও কাছে শিল্পই জীবিকার প্রধান অবলম্বন। আমাদের বাঙালিদের অন্যতম প্রাচীন ও গৌরবময় শিল্প হলো হস্তশিল্প। মানুষের হাতে তৈরি এসব শিল্পকর্ম কখনও মেশিনের সাহায্য ছাড়াই, কখনও খুব সামান্য যান্ত্রিক সহযোগিতায় গড়ে ওঠে। কাপড়, মাটি, বাঁশ, কাঠ, ধাতু, চামড়ার মতো উপকরণ ব্যবহৃত হয় এসব শিল্পে।
ধারণা করা হয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগেই হস্তশিল্পের সূচনা হয়। তখন মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে এসব সামগ্রী তৈরি করত। পরিবারভিত্তিকভাবে হস্তশিল্পের কাজ চলত, যা ছিল জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। শাসকশ্রেণি ও অভিজাতরা হস্তশিল্পের নানা পণ্য ব্যবহার করত, ফলে ক্রমেই এর প্রসার ঘটতে থাকে। উপহার হিসেবেও এসব দ্রব্যের কদর ছিল চমকপ্রদ।

ছবি: সংগৃহীত
আদি ও মধ্যযুগীয় বাংলায় বয়নশিল্প, ধাতব কাজ, রুপার অলঙ্কার, কাঠের কাজ, বেত ও বাঁশের তৈরি সামগ্রী এবং মাটির মৃৎপাত্র ছিল হস্তশিল্পের গৌরবময় নিদর্শন। গ্রামের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন ও আবেগ শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলত। আয় কম হলেও অনেকে ভালোবেসে বংশপরম্পরায় হস্তশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
বর্তমানেও কিছু রুচিশীল মানুষ এবং বড় কিছু ব্র্যান্ড এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নিরলস কাজ করে চলেছে। মোঘল আমল থেকে শুরু করে আজও বাংলাদেশের হস্তশিল্প বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিদেশে নানা হস্তশিল্পপণ্য রপ্তানি হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে এখন আর আগের মতো বিস্তৃত বাজার নেই। শহরে কিছুটা চাহিদা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নামমাত্র পারিশ্রমিকের কারণে অনেক কারিগর হতাশ জীবন যাপন করছেন। ফলে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। হস্তশিল্পের চাহিদা বাড়ে মূলত বিশেষ অনুষ্ঠান বা মেলার সময়। তাছাড়া বিদেশেও রপ্তানির ক্ষেত্রে মূলধন সংকট ও উন্নত কাঁচামালের অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক নানা শিল্পপণ্যের প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্যের বাজারও ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
দেশীয় শিল্পের টিকে থাকতে চাইলে দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। শিশুদের মধ্যে হস্তশিল্পের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে বিদ্যালয়ে হস্তশিল্প মেলা আয়োজন করা যেতে পারে। উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎসাহমূলক কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন। তৃণমূল কারিগরদের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি উন্নত কাঁচামাল ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করাও জরুরি।
শত বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে। তবেই প্রাচীন বাংলার গৌরবময় হস্তশিল্প আধুনিক যুগেও টিকে থাকবে নতুন প্রাণ নিয়ে। বাংলার প্রাচীন হস্তশিল্প আজও বয়ে চলেছে জীবনের গল্প। হাজারো চ্যালেঞ্জের মাঝেও টিকে থাকা এই শিল্প আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীলতার প্রতিচ্ছবি।