বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নতুন আমীর নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারে সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে সাম্প্রতিক গুঞ্জন রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া খবরে দাবি করা হচ্ছে, বর্তমান আমীর ডা. শফিকুর রহমান ওএসডি পদে থাকবেন এবং নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া, তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বদিউল আলম মজুমদারকে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে গুঞ্জন চলছে। এই গুঞ্জনের পেছনে রাজনৈতিক সমীকরণ এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব নির্বাচন সবসময়ই একটি গোপনীয় ও সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া। ডা. শফিকুর রহমান ২০২০ সাল থেকে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে দলটি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর রাজনৈতিক মূলধারায় ফিরে এসেছে। গত ২২ মে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে তিনি সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানান, যা দলের রাজনৈতিক তৎপরতার ইঙ্গিত দেয়। তবে, নতুন আমীর নির্বাচনের গুঞ্জন দলের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের নাম উঠে এসেছে, যিনি সিনিয়র নায়েবে আমীর এবং রাজশাহী মহানগরীর সাবেক আমীর। তিনি দলের অভিজ্ঞ নেতা এবং তৃণমূল পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
জামায়াতের ইতিহাসে নেতৃত্ব পরিবর্তন প্রায়ই দলের অভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত দ্বন্দ্বকে সামনে এনেছে। দলের মধ্যে সংস্কারপন্থী এবং কট্টরপন্থীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা একটি চ্যালেঞ্জ। ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে সংস্কারপন্থী নেতাদের আধিপত্য লক্ষ্য করা গেছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন আমীর নির্বাচন দলের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান আমীর হন, তবে দলটি অভিজ্ঞতার দিকে ঝুঁকতে পারে, যা স্থিতিশীলতা আনতে পারে। তবে, এটি সংস্কারপন্থীদের জন্য কিছুটা পিছিয়ে পড়ার ইঙ্গিতও হতে পারে। ডা. শফিকুর রহমানকে ওএসডি এবং নায়েবে আমীর হিসেবে রাখার পরিকল্পনা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার একটি কৌশল হতে পারে। তিনি দলের একজন গ্রহণযোগ্য নেতা এবং তার অভিজ্ঞতা দলের জন্য মূল্যবান। তবে, এই ধরনের পদক্ষেপ তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে, যেমনটি ২০২০ সালে নতুন কমিটি গঠনের সময় দেখা গিয়েছিল। তাই, নেতৃত্ব পরিবর্তনের এই গুঞ্জন দলের ঐক্য এবং গতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
“নেতৃত্ব পরিবর্তনের আড়ালে জামায়াত কি নতুনভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে ফিরতে চায়, নাকি এটি কেবল এক অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ?”
— রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে গুঞ্জন রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ডা. শফিকুর রহমানকে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বদিউল আলম মজুমদারকে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে। তবে, এই গুঞ্জনের সত্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, বদিউল আলম মজুমদার রাজনৈতিক কোনো সক্রিয় সদস্য নন। তিনি একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বর্তমানে তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে বলেন, “সব নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করব।” তার এই ভূমিকা এবং জামায়াতের সঙ্গে তার কোনো সরাসরি সংশ্লিষ্টতা না থাকায় তার নাম উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে আসা অবাস্তব মনে হচ্ছে। এছাড়া, বাংলাদেশের সংবিধানে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদের কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই, যা এই গুঞ্জনের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও কমিয়ে দেয়।
তবে, এই গুঞ্জনের পেছনে রাজনৈতিক সমীকরণের একটি দিক থাকতে পারে। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত রাজনৈতিক মূলধারায় ফিরে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে দলটি জাতীয় সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা রয়েছে। ডা. শফিকুর রহমানের মতো একজন অভিজ্ঞ নেতাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের গুঞ্জন জামায়াতের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর একটি ইঙ্গিত হতে পারে। তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু জামায়াতের ইতিহাস, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকা, এখনও জনমনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি করে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে, যা তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ২০২৪ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে, তবুও জামায়াতের জনসমর্থন সীমিত। এই প্রেক্ষাপটে তাদের জাতীয় সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হলে তা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। জামায়াতের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও উপেক্ষণীয় নয়। সংস্কারপন্থী ও কট্টরপন্থীদের মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে, এবং জাতীয় সরকারে ভূমিকা পেলে এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমীর নির্বাচন এবং জাতীয় সরকারে ভূমিকা নিয়ে গুঞ্জন যদিও আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তবে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নেতৃত্ব পরিবর্তন দলের ঐক্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এবং জাতীয় সরকারে ভূমিকা পালন বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। তবে, এই গুঞ্জন জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে নতুন আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেছে।