কুয়েতের রুক্ষ মরুভূমি অঞ্চলে এক নীরব কৃষি বিপ্লব ঘটাচ্ছেন বাংলাদেশের কৃষকরা। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা ও দূরদর্শিতা ওফরা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িকে পরিণত করেছে সবুজের সমারোহে। দেশি-বিদেশি নানা জাতের শাক-সবজি ও ফলমূল ফলিয়ে এখানকার বাংলাদেশি শ্রমিকরা শুধু নিজেদের ভাগ্যই বদলাচ্ছেন না, কুয়েতের স্থানীয় অর্থনীতিতেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
কুয়েতের সেন্ট্রাল সবজি মার্কেট ও সুপারশপগুলোতে এখন বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন সবজির ছোঁয়া। এসব সবজির বেশিরভাগই আসে মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা বাংলাদেশি পরিচালিত ‘মাজরা’ (কৃষি খামার) থেকে। স্থানীয় কুয়েতিদের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে বাংলাদেশিরাই এসব মাজরায় প্রধানত শ্রমিক দিয়ে কাজ করান।
সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বাসিন্দা মাহমুদ আলী এমন একজন অগ্রপথিক। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি কুয়েতের মাজরায় সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করছেন। তার তত্ত্বাবধানে ১৫-২০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে উৎপাদন করছেন টমেটো, বেগুন, বরবটি, লাল শাক, ধনে পাতা, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কলার পাতা, কলমি শাক, কুমড়াসহ হরেক রকম দেশি-বিদেশি ফল ও সবজি।
শ্রমিক জসিম হাওলাদার জানান, কুয়েতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা বন্ধ থাকায় দক্ষ লোকবলের অভাবে অনেক উর্বর জমিও অনাবাদি পড়ে আছে। তবে, কৃষি খাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা ও সুনাম দেশটিতে সুবিদিত। অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় বাংলাদেশিরা যে নিষ্ঠা ও মেধার পরিচয় দেন, তাতে মাজারার মালিক ও স্থানীয়রা অত্যন্ত সন্তুষ্ট।
এই সাফল্য বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান করার এক বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে। কৃষি কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশি শ্রমিক রাসেল মিয়া জানান, তাদের দৈনিক মজুরি ৮ থেকে ১০ দিনার। কোম্পানির ভিসায় যারা আসেন, তাদের বেতন ৮০ থেকে ১৫০ দিনার পর্যন্ত, যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ মালিকই বহন করেন। এই রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিলে কৃষি খাতে কম খরচে সরকারিভাবে আরও বেশি শ্রমিক কুয়েতে পাঠাতে পারে। এটি দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও বাড়িয়ে দেবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোরালো অবদান রাখবে।
মরুভূমির এই সবুজায়ন কেবল কৃষিক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এটি স্থানীয় পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। শীতকালে কুয়েতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কুয়েতিরা তাদের পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে মাজরাগুলোতে ঘুরতে আসেন। এমনকি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও এক মাজরা থেকে অন্য মাজরায় ঘুরে বেড়ান, যা এখানকার জীবনযাত্রায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
মরুর বুকে বাংলাদেশিদের এই সাফল্য প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম আর দৃঢ় মনোবল থাকলে যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও সবুজের সমারোহ ঘটানো সম্ভব।