জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ড. ইউনূস: কৌশল নাকি বাস্তবতা?

New-Project-64.jpg
মুহাম্মদ নূরে আলম এম আলী

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করছেন না—পরিকল্পনা উপদেষ্টার এই ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান গুঞ্জনের ইতি টানা গেলেও তৈরি হয়েছে নতুন প্রশ্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পদত্যাগের ইঙ্গিত ছিল মূলত এক ধরনের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কৌশল—একটি ‘পপুলারিটি টেস্ট’। এমন সময়ে এই ঘোষণা এল, যখন রাজনীতিতে অস্থিরতা, আইন নিয়ে বিতর্ক, প্রশাসনিক অচলাবস্থা এবং বিভিন্ন দলের তীব্র আন্দোলনের হুমকিতে সরকার প্রায় কোণঠাসা।

গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার একটি অনির্ধারিত বৈঠকে পদত্যাগের ইঙ্গিত দেওয়ার খবর আসে গণমাধ্যমে। সূত্র হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলাম। এরপর থেকেই শুরু হয় চাপ প্রয়োগ, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক বার্তা আদান-প্রদান।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এমনকি নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগেরও ঘনিষ্ঠ মহল থেকে প্রকাশ্যে কিংবা পরোক্ষে প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানানো হয়। কারণ, এক কথায় বলা যায়—ড. ইউনূস এই মুহূর্তে এমন একটি জায়গায় অবস্থান করছেন, যেখানে তিনি চলে গেলে পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ধসে পড়ার আশঙ্কা ছিল।

রাজনীতিবিদ রুমিন ফারহানা মনে করেন, পদত্যাগের ভাবনার বার্তা একটি কৌশল হতে পারে। তার ভাষায়, “তিনি এমনভাবে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন যেন সবাই এসে তাকে অনুরোধ করে ফেরাতে বাধ্য হয়। এটি একধরনের রাজনৈতিক নাটক।”

এর আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এক পর্যায়ে মন্ত্রীসভায় আভাস দিয়েছিলেন যে, তিনি ‘তিন মাসের ছুটি’ নিতে চান। সেই সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে দেখেছিলেন জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটি কৌশল হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর শাসনকালে গড়ে ওঠা ‘একদলীয় শাসনব্যবস্থা’ (BAKSAL) কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা পরিমাপ করা। যদিও শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

১৯৮৭ সালের দিকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণআন্দোলনের চাপে কিছুদিন ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন’-এর ইঙ্গিত দেন এবং পদত্যাগের বার্তা ছড়িয়ে দেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, এটি ছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশল এবং নিজের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের আনুগত্য যাচাই করার পরীক্ষা।

১/১১ সেনাসমর্থিত সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে বিদেশ যেতে বলা হয়েছিল এবং নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা চেয়েছিলেন তিনি আপাতত ‘পিছু হটুন’। সেই সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি যদি না থাকি, কী হয় তা দেখে নেওয়ার সময় এসেছে।” এটিকেও রাজনৈতিকভাবে একটি কৌশলী ‘পপুলারিটি টেস্ট’ হিসেবে দেখা হয়—জানতে চাওয়া, দল ও জনগণ কতটা প্রস্তুত তাঁকে ছাড়াই রাজনীতি করতে।

 অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ ইঙ্গিত রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের আলোড়ন তুললেও, শেষপর্যন্ত তাঁর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনেককেই স্বস্তি দিয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—যদি তিনি সত্যিই সরে দাঁড়াতেন, তাহলে লাভবান হতো কারা?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ড. ইউনূসের পদত্যাগে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো সেইসব রাজনৈতিক শক্তি, যারা শুরু থেকেই এই সরকারের প্রতি আস্থা রাখেনি এবং বরাবর অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাঁর পদত্যাগ হলে তারা সেটিকে ব্যবহার করতো সরকারের ব্যর্থতার প্রমাণ হিসেবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন একটি মুহূর্তে—যখন সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়নের মাঝপথে রয়েছে এবং প্রশাসনিকভাবে বড় ধরনের রদবদলের দরজা খোলা—তখন প্রধান উপদেষ্টার হঠাৎ সরে যাওয়া সরকারের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য তৈরি করতে পারতো। এর প্রতিক্রিয়া পড়তো আন্তর্জাতিক মহলেও। বাংলাদেশ সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বব্যাংকসহ অনেক সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গিতে নেতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারতো।

এছাড়া, বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণের ক্ষেত্রে স্থবিরতা তৈরি হতো। অনেক বিনিয়োগকারী, যারা ইতিমধ্যে নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষণমূলক অবস্থানে আছেন, তারা আরও একধাপ পিছিয়ে যেতেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি নতুন করে অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যেত।

ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবেও আন্তর্জাতিক পরিসরে একজন পরিচিত মুখ এবং গণমানুষের কাছে এখনো একধরনের নিরপেক্ষতার প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। তাই হঠাৎ তাঁর সরে যাওয়া মানেই জনআস্থার বড় ধাক্কা। অনেকেই এটিকে “রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মুখ থুবড়ে পড়া” হিসেবে বিবেচনা করতেন।

তাই রাজনৈতিকভাবে বলা যায়, তাঁর না যাওয়া শুধু একটি ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নয়—বরং এটি দেশের রাজনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক আস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার একটি কৌশলী পদক্ষেপ। আর এই পদক্ষেপে ক্ষয়রোধ হয়েছে সেইসব শক্তির, যারা চেয়েছিল একটি নতুন অনিশ্চয়তার জন্ম হোক।

সাধারণ মানুষের মধ্যে ড. ইউনূসের ভাবমূর্তি এখনো নিরপেক্ষ ও কার্যকর নেতৃত্বের প্রতীক। তার নেতৃত্বে দেশের আর্থিক খাত কিছুটা হলেও স্থিতিশীল হয়েছে, বিদেশি পাওনা পরিশোধে অগ্রগতি হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে আস্থার সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তার সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা—এই সিদ্ধান্ত যে কেবল অভ্যন্তরীণ চাহিদা থেকেই আসেনি, বরং আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকেও তার দায়িত্বে থাকার বার্তা এসেছে—তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যেভাবে বললেন—“আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব বড় দায়িত্ব, এই দায়িত্ব ছেড়ে আমরা যেতে পারবো না”—তা থেকেই স্পষ্ট যে সরকার ভেঙে ফেলা বা নেতৃত্ব বদলানো এই মুহূর্তে দেশের জন্য আত্মঘাতী হতে পারত।

ড. ইউনূস এমন এক ভারসাম্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যার নেতৃত্বে সরকার বিরোধী দলের চাপ সামাল দিতে পারছে, আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে পারছে। এই মুহূর্তে তার নেতৃত্বই যেন অন্তর্বর্তী সরকারের “পলিটিক্যাল লাইফ সাপোর্ট”।

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট, নয়াদিগন্ত, বিজনেস মিরর এবং শিরোনাম মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে সাব-এডিটর ও কনটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এনভিডিয়া ও দুবাই ওয়ান মিলিয়ন প্রমপ্টার্স থেকে জেনারেটিভ এআই ও প্রমপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সনদপ্রাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠকবান্ধব, প্রাসঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম কনটেন্ট তৈরিতে তার দক্ষতা অনন্য। ব্যবসা, প্রযুক্তি, সমাজ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখিতে তার পারদর্শিতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘স্বপ্নবাজ ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘রেঁনেসা ফাউন্ডেশন’-এর মিডিয়া প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

scroll to top