অভিনয় ও রাজনীতির দীর্ঘ পথচলা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরের ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা সোহেল রানা। জানালেন, আর দেখা যাবে না তাঁকে বড় পর্দায় কিংবা রাজনীতির মঞ্চে। প্রায় ৫২ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে বয়সজনিত কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
সিনেমার ‘মাসুদ রানা’ এখন অবসরে
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক উজ্জ্বল নাম সোহেল রানা। আসল নাম মাসুদ পারভেজ হলেও ‘সোহেল রানা’ নামেই তিনি পরিচিত হয়েছেন পুরো দেশে। ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক হিসেবে চলচ্চিত্রে তাঁর পথচলা শুরু। এটি ছিল দেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা, যা আজও ইতিহাসে স্থান করে আছে।
এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন কাজী আনোয়ার হোসেনের জনপ্রিয় চরিত্র ‘মাসুদ রানা’-কে ঘিরে নির্মিত ‘মাসুদ রানা’ সিনেমায়। এই সিনেমার পরিচালকও ছিলেন তিনি নিজেই। এই ছবির মাধ্যমেই তিনি জাতীয়ভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন একজন অভিনেতা ও নির্মাতা হিসেবে।
সোহেল রানা বলেন, “১৯৭৩ সালে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। এরপর কখন যে ৫২ বছর পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। অভিনয় এখনও আমার ভেতরে, কিন্তু আর পারছি না।”
শরীর আর আগের মতো সাড়া দেয় না বলেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি। “৭৯ বছর বয়সে এসেছি। এখন অভিনয় বা রাজনীতি—কোনোটাই আগের মতো করে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এসব করতে গেলে পড়াশোনা, চিন্তা, পরিশ্রম—সব দরকার। সেটা আর শরীর সাপোর্ট করছে না,” বলেন বর্ষীয়ান এই অভিনেতা।
রাজনীতির মাঠেও সক্রিয় ছিলেন
শুধু সিনেমা নয়, দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন সোহেল রানা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন বহু বছর। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। তবে এবার রাজনীতির সঙ্গেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানালেন।
তাঁর কথায়, “রাজনীতি করতে হলে নিয়মিত থাকতে হয়। মানুষের কাছে যেতে হয়, মত প্রকাশ করতে হয়। আমি আর সেটা পারছি না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রাজনীতি থেকেও অবসর নিচ্ছি।”
যদিও তিনি অভিনয় ও রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন, তবে এখনও একটি স্বপ্ন বেঁচে আছে তাঁর মনে। সেটা হলো সিনেমা নির্মাণ। তিনি বলেন, “মনে আছে, একটা সিনেমা বানাব। কিন্তু সেটা বোধ হয় আর হবে না। বয়সের কারণে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।”
তাঁর এই ইচ্ছাকে ঘিরে অনেক ভক্তই আশা করেছিলেন আরও একটি সিনেমা দেখার, যেখানে হয়তো থাকবে সোহেল রানার শেষ চিহ্ন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, বাস্তবতা অনেক কঠিন।
সর্বশেষ দেখা মিলেছিল ‘মধ্যবিত্ত’ ছবিতে
সোহেল রানা সর্বশেষ বড় পর্দায় দেখা দিয়েছিলেন তানভীর হোসেন পরিচালিত ‘মধ্যবিত্ত’ সিনেমায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন শিশির সরদার, মায়িশা প্রাপ্তি, প্রয়াত মাসুম আজিজ, বড়দা মিঠু, সমু চৌধুরী, এলিনা শাম্মি, ওমর মালিক, আমির সিরাজী এবং শবনম পারভীন।
১৩টি হলে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিটি মধ্যবিত্ত সমাজের টানাপোড়েন, আবেগ, সংকট ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। সোহেল রানার চরিত্র দর্শকদের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলেছিল।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সোহেল রানার অবদান অনস্বীকার্য। প্রযোজক, অভিনেতা ও পরিচালক—সব ভূমিকাতেই তিনি রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি। প্রায় ৩ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি, যার মধ্যে অনেকগুলোই এখন ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত। একাধিক জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে— ‘ওরা ১১ জন’, ‘মাসুদ রানা’, ‘রাজপথ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অপরাধী’, ‘জয় পরাজয়’, ‘জননী’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আদরের ছেলে’ প্রভৃতি।
একটি প্রজন্মের নায়ক
সোহেল রানা ছিলেন একাধিক প্রজন্মের প্রিয় নায়ক। নব্বই দশকের দর্শকদের কাছে যেমন তিনি ছিলেন অ্যাকশন হিরো, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের কাছেও তিনি একজন সম্মানিত শিল্পী। তাঁর সংলাপ, স্টাইল, অভিনয়গুণ—সবই ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের মন।
অভিনয় ও রাজনীতির রঙিন জগত থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানিয়েছেন মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। তাঁর এই সিদ্ধান্তে ভক্তদের মনে কিছুটা হলেও শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে দীর্ঘ ৫২ বছরের যে অধ্যায় তিনি রচনা করেছেন, তা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতে।