সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ মিছিল যেন অপ্রতিরোধ্য। আজ এখানে তো কাল ওখানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। সম্পতি বরগুনায় এক সঙ্গে তিন ভাইয়ের সড়কে মৃত্যু। নিহতদের মায়ের কান্না নাড়া দিয়েছে সবাইকে।
ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার রোডে ১০ জনের মৃত্যু। বাবা মা মারা গেছেন সঙ্গে সঙ্গে। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন সাত বছর বয়সী আরাধ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানাচ্ছেন একেকজন একেক প্রতিক্রিয়া। ছোট মেয়েটি জানেনা তার আদরের বাবা মা বেঁচে আছে কি না! ধরুন এ যাত্রায় উন্নত চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলো মেয়েটি।
ক্ষুধা পেলে কাকে বলবে আমার ক্ষিদে পেয়েছে? কে নিবে তাকে স্কুলে? বিকেলে অন্য ছেলেমেয়ে তাদের বাবা মায়ের হাত ধরে যখন ঘুরতে যাবে আরাধ্য তখন কার হাত ধরে ঘুরতে যাবে? একবার আরধ্যকে নিজের সন্তানের স্থানে রাখুন, কেমন অনুভতি হবে আপনার। শরীর শিহরে উঠছে না তো। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে? নিশ্বাস নিতে পারছেন না।
বরগুনায় সেই মায়ের কথা ভাবুন। নাড়ি ছেড়া তরতাজা তিন সন্তান আজ কবরে। ঈদ কেমন কেটেছে সেই মায়ের? কেউ কি খোঁজ নিয়েছে। ঈদের দিন কোনো রান্না হয়েছে কি না! খোঁজ নিয়েছেন। এমন হাজারো ঘটনা দেশে জুড়ে। একটি মাত্র কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। এই দুই ঘটনার পর প্রশাসন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা কি সচেতন হয়েছি ? উত্তর আসবে না।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হলো ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক, অবৈধ যান ও ক্লান্তি নিয়ে চালকদের গাড়ি চালানো। আপ্তবাক্যের মতো সবাই সেটা আওড়ালেও না সরকারি কর্তৃপক্ষ, না পুলিশ, না মালিকপক্ষ সেটা মানে। ফলে নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার দুষ্টচক্র থেকে সড়ক বেরিয়ে আসতে পারছে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে। তাহলে কি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এটা ধরে নিয়েছেন যে সড়ক, সেতু তৈরি করলে আপনা–আপনি দুর্ঘটনা সব হাওয়া হয়ে যাবে? উত্তর আসবে না। এর প্রমাণ ঢাকা-মাওয়া সড়ক। পৃথিবীর কোনো দেশেই আমাদের মতো করে পাইকারি হারে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় না।
তারপরও অনেক গাড়ির মালিক ফিটনেস সনদ নিতে আগ্রহী নন। কারণ, তাঁরা জানেন যে সড়ক–মহাসড়কে নানাভাবে ম্যানেজ করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো যায়। কিন্তু কেন! এ দায় কার? তাহলে কি এভাবেই চলবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল? আর আরাধ্যরা হারাতে থাকবে বাবা মাকে। প্রশাসন মিডিয়ার সামনে এসে কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে বলছে আমার ব্যবস্থা নিচ্ছি।
বাংলাদেশের মহাসড়কে যাত্রী পরিবহনে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজি-বাইক, নসিমন-করিমন, ভটভটির মতো বহুমাত্রিক যানবাহন চলাচল করে। এমনকি পণ্যবাহী গাড়িতেও যাত্রী তোলা হচ্ছে অহরহ যা উৎসবের সময় আরও বেড়ে যায়। মহাসড়কে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, অবৈধভাবে চলাচলকারী এসব যানবাহনের চলাচল দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাই ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা যখন বাড়িতে সন্তানদের সময় দেই; তখন পারিবারিক আলোচনার একটি বিষয়বস্তু হতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা। তাতে শিশুরা আস্তে আস্তে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন হবে। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা তার সন্তানকে মোটরসাইকেলে করে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু বাবা হেলমেট ব্যবহার করলেও সন্তানের জন্য হেলমেট রাখেন না। আরও দেখা যায়, বাবা-মা দু’জনই হেলমেট পড়ে আছেন, তাদের মাঝখানে সন্তানকে বসিয়ে রাখেন হেলমেট ছাড়া।