রাক্ষুসে থাবায় ধ্বংস হচ্ছে বনের পরিধি, বাড়ছে ঘের

New-Project-2.jpg

রাক্ষুসে থাবায় ধংশ হচ্ছে বনের পরিধি, বাড়ছে ঘের

পটুয়াখালী প্রতিনিধি

সংরক্ষিত বনে চিহ্নিত বনখেকো চক্রের রাক্ষুসে থাবায় প্রতি বছর ক্রমেই বনের পরিধি কমে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দখলদারের সংখ্যা। আর এ সুযোগে সংরক্ষিত বনে বাধাহীনভাবে একের পর এক নির্মাণ করা হচ্ছে মাছের ঘের। এসব ঘের নির্মাণে কাটা পড়ছে শত শত গাছ এবং উপড়ে ফেলা হচ্ছে মাটি। সরেজমিন পরিদর্শনে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়নের চর যমুনা সংলগ্ন মাঝের চর এলাকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে।

পরিদর্শনকালে মাঝের চর এলাকার একাধীক ব্যক্তি জানান, এটি শুধু নামেই সংরক্ষিত বন। এখানে দিবালোকে সব ঠিকঠাক থাকলেও রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে একের পর এক গাছ। কোন কোন গাছ রাতেই পাচার করে দেয়া হচ্ছে। আবার কোন কোন গাছ কেটে বনেই ফেলে রাখছে, সুযোগ বুঝে পাচার করছে চক্রটি।  দীর্ঘদিন ধরে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়নের চরযমুনা সংলগ্ন মাঝেরচরের সংরক্ষিত বন এভাবেই উজাড় হচ্ছে।

অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে একদিকে বন উজাড় করা হচ্ছে অন্যদিকে উজাড় করা বনের জমি দখল করে নতুন নতুন মাছের ঘের নির্মাণ অথবা পুরোনো ঘেরের আয়তন বড় করছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। প্রকাশ্য দিবালোকে এতকিছু ঘটলেও বনরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘বন বিভাগ’ যেন উদাসীন। এলাকাবাসী জানান, প্রভাবশালী এ চক্রটি গাছ কেটে একসঙ্গে পাচার করতে না পারলে আশপাশের বাড়ির পুকুর ও মাছের ঘেরের মধ্যে কাটা গাছ লুকিয়ে রাখে। কেটে ফেলে রাখা সেসব গাছের টুকরো (গুড়ি) কিংবা ডাল-পালা প্রকাশ্যে লাকড়ী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যায় স্থানীয় নারীরা। তাদের অভিযোগ, গাছ কাটার বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ফাঁসাতে তার বাড়ির পুকুর কিংবা মাছের ঘেরেই ফেলে রাখা হয় কাটা গাছের টুকরো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, সম্প্রতি উজাড় করা বনভূমির জমি দখল করে জুয়েল সিকদার নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির মালিকানাধীন মাছের ঘেরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। ২০২০ সাল থেকে বন ধ্বংসের মাত্রা বেড়েছে বলে জানান তারা। ধ্বংস করা বনায়নের জমি দখল করে তখন আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় মাছের ঘের করেছিলেন এই জুয়েল সিকদার। আওয়ামী লীগের পতনের পর বর্তমানে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে জুয়েল সিকদার বনের জমি দখল করে নতুন বাঁধ নির্মাণ করে তার ঘেরের আয়তন বাড়িয়েছেন। ঘেরের পানি নিষ্কাশনের জন্য বনের মধ্যে ভেকু মেশিন দিয়ে তৈরি করেছেন নিজস্ব নালা ও কালভার্ট। তাই বন উজাড় হওয়ার পেছনে জুয়েল সম্পৃক্ত আছে বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ঘের মালিক জুয়েল সিকদার জানান, তাঁকে হয়রানি করতে স্থানীয় একটি গোষ্ঠী সাংবাদিকদের কাছে তথ্য দিচ্ছে। বনের ভিতর ভেকু মেশিন লাগিয়ে মাটি কাটা বিষয়ে তিনি জানান,তাঁর ঘেরের পাড় সামান্য মেরামত করতে নতুন করে মাটি দিয়েছেন। তবে তিনি কোন গাছ কাটেননি। সংরক্ষিত বনের ভেতরে এটা তিনি করতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাঁর ঘেরটি খুবই ছোট। মাত্র তিন একরের। যারা আরো বিশাল বিশাল ঘেরের মালিক তাদের সবার ঘেরের পাড়ও তো বনের পাশ দিয়ে। সেটায় তো কেউ কিছু বলছে না। তাছাড়া তাঁর রেকর্ডিও জমি এবং বন্দোবস্ত নেওয়া চাষের জমিতে ঘের করা হয়েছে বলে দাবী করেন তিনি। 

এ বিষয়ে মাঝের চরের সংরক্ষিত এই বনাঞ্চল ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নারায়ন চন্দ্র মজুমদার জানান, বনের ভিতর নালার মত দেখছি। মাটি কাটার ভেকু মেশিন গিয়ে পাইনি। বনের ভিতর যে আইল ছিলো সেটাই বড় করা হয়েছে। এখন সেটা বনের ১০০ মিটার ভেতরে পড়ছে। প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গাছ কাটার বিষয়টি নজরে আসেনি। তবে ডাল-পালা এলাকার লোকজন নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে।’ 

এ বিষয়ে রাঙ্গাবালী রেঞ্জ কর্মকর্তা অমিতাভ বসু জানান, তিনি বর্তমানে ছুটিতে রয়েছেন। এ বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন এবং মাঝের চরের ফরেস্টার যিনি রয়েছেন তাঁকে আজকের মধ্যে মামলা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বনের ক্ষতি করে কোন অবস্থায় কেউ রেহাই পাবে না বলেও দাবী করেন তিনি।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘মাঝের চর এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল কেটে মাছের ঘের করার বিষয়ে খবর পেয়েছি। ওই জায়গাগুলো ইতিমধ্যে পরিদর্শন করেছি। সরকারি জমি দখল করে যে মাছের ঘের নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো উচ্ছেদের জন্য শিগগরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’তিনি আরও বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল আমাদের দেশের সম্পদ। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্নভাবে বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস এবং অপব্যবহারের যে খবরগুলো আমরা পাচ্ছি, সেগুলো আমরা বিভাগীয় বন কর্মকর্তাসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। যারা এখানে দোষী আছে, সেটা যদি কোন সরকারি কর্মকর্তাও হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রায় ৫০ বছরের পুরনো এ বনায়ন জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি পাখপাখালির আবাসস্থল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে এলাকার মানুষকে ঢাল হিসেবে রক্ষা করে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

scroll to top