প্রতিবছরের মতো এবারও ৩১ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ১৯৮৭ সালে দিবসটি প্রবর্তনের পর থেকে প্রতিটি বছরই নতুন প্রতিপাদ্য নিয়ে আসে আমাদের সামনে। এবারের প্রতিপাদ্য—“উজ্জ্বল পণ্য, অন্ধকার উদ্দেশ্য” (Bright Products. Dark Intentions)—বিশেষভাবে তরুণদের প্রতি তামাক কোম্পানিগুলোর বিপজ্জনক ও বিভ্রান্তিকর বিপণন কৌশলগুলোর মুখোশ উন্মোচনের আহ্বান জানায়।
তামাক পণ্য এখন আর শুধু সিগারেট বা বিড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নতুন প্রজন্মকে লক্ষ্য করে ই-সিগারেট, হিট-নট-বার্ন পণ্য, নিকোটিন পাউচ এবং ফ্লেভারযুক্ত ভ্যাপারের মতো পণ্যের বাজার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। চকচকে মোড়ক, সুগন্ধি ফ্লেভার, আর সেলিব্রেটিদের মাধ্যমে পরিচালিত বিজ্ঞাপন—সব মিলে তরুণদের এই পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করা হচ্ছে ভয়ানকভাবে।
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটি ‘ভ্যাপিং’ ছবি আপলোড করলে সেটা কেবল এক বন্ধুর প্রশংসা নয়, এক নতুন আসক্তির পথে যাত্রা। WHO জানায়, বিশ্বজুড়ে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩.৭ কোটি শিশু তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে।
বাংলাদেশেও তামাকের করাল ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ‘তামাক বিরোধী জোট’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ সরাসরি তামাক পণ্য ব্যবহার করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ কিশোর ও তরুণ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিদ্যালয়ের আশপাশে অবাধে পাওয়া যায় তামাকজাত পণ্য, যার মাধ্যমে শুরু হয় ‘শখের নেশা’—পরে রূপ নেয় মারাত্মক আসক্তিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে যেখানে তামাক শিল্পের প্রধান ভোক্তা ছিল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা, এখন তারা তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেছে। নারী, কিশোর ও তরুণদের ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে ‘কিউট’ ফ্লেভার, রঙিন ক্যান ও ইনফ্লুয়েন্সার-ভিত্তিক বিপণন কৌশল। WHO দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সাইমা ওয়াজেদ এক বিবৃতিতে বলেন, “তামাক কোম্পানিগুলোর চোখ এখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে। এই প্রজন্মকে রক্ষা করতেই আমাদের আজকের প্রতিজ্ঞা প্রয়োজন।”
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিয়া ইসলাম বলেন, “ই-সিগারেট নিয়ে প্রথমে কৌতূহল ছিল, পরে আসক্ত হয়ে পড়ি। এখন বুঝি, এটা একটা ফাঁদ ছিল। আমি চাচ্ছি অন্যরা যেন এই ভুল না করে।”
কী করা উচিত?
বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা একমত, সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে নিচের পদক্ষেপগুলো নিতে হবে:
- ফ্লেভারযুক্ত তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা
- প্যাকেজিংয়ে সতর্কবাণী বড় করে দেখানো এবং আকর্ষণীয় ডিজাইন নিষিদ্ধ করা
- তামাকজাত পণ্যের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা বন্ধ করা
- তরুণদের জন্য কাউন্সেলিং ও তামাক ছাড়ার সহায়তা কর্মসূচি চালু করা
- তামাকজাত পণ্য বিক্রি ও ব্যবহারে আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা
তামাকমুক্ত ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নয়—এটা আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টায় সম্ভব। সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও গণমাধ্যম—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তরুণদের সচেতন করে তুলতে হবে, তাদের জীবন যেন ঝুঁকির চকচকে মোড়কে ঢেকে না যায়।
একটা নিঃশ্বাসের দাম কত? একজন সন্তানের মুখের হাসি, এক মায়ের দীর্ঘ জীবন, এক তরুণের স্বপ্ন—এই সবকিছুর মাঝেই নিহিত সেই উত্তর।