বিশ্ব বাবা দিবস আজ

বাবা— নিঃশব্দ ভালোবাসার সবচেয়ে বড় উচ্চারণ

New-Project-28-1.jpg

বিশ্ব বাবা দিবস আজ

২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ ফারহানা হোসেন

একটি সময় ছিল, যখন বাবা মানে ছিলেন কঠিন মুখের এক মানুষ—সদা গম্ভীর, নিয়ম-কানুনের বাহক। সময় বদলেছে, বদলেছে সম্পর্কের প্রকাশভঙ্গি। এখন বাবারা সন্তানকে কাঁধে বসিয়ে সেলফি তোলেন, স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়া স্বপ্নটা যাতে কোনো অজুহাতে থেমে না যায়। তবুও আজও বাবার ভালোবাসা থেকে যায় একরকম নিঃশব্দ। বাবা দিবসে তাই প্রশ্ন জাগে—আমরা কি আদৌ চিনতে পেরেছি তাঁকে?

বর্তমান জীবনের চাপ, দৌড়ঝাঁপ, অর্থনৈতিক সংকট—সবকিছু সামলে একজন বাবা যখন সকালে সন্তানকে স্কুলে দিয়ে, সারাদিন অফিসে খেটে, রাতে বাসায় ফিরে হাসিমুখে বলে, “কেমন গেল তোমার দিন?”, তখন সেটা শুধু একটা প্রশ্ন নয়, সেটা তাঁর ভালোবাসার সবচেয়ে পরিপূর্ণ প্রকাশ। অথচ আমরা হয়তো ব্যস্ত থাকি নিজের ফোন, নিজের দুঃখ আর নিজের দুনিয়া নিয়ে। বাবার ক্লান্ত মুখটা আমাদের চোখে পড়ে না।

আজকের শহুরে সমাজে অসংখ্য বাবা রয়েছেন, যাঁরা সন্তানদের পড়াশোনা, বিয়ে, ক্যারিয়ার সব গুছিয়ে দিয়ে এখন একাকিত্বের সঙ্গে লড়ছেন। তাঁরা হয়তো দিনের পর দিন সন্তানের একটা ফোন কলের অপেক্ষায় থাকেন। ‘ব্যস্ত আছি’ বা ‘পরে কথা বলি’—এই শব্দগুলো তাঁদের ভালোবাসার ভাষা বোঝার অধিকার যেন কেড়ে নেয়। বাবা দিবসে আমরা কি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারি না? একটা দুপুরের খাবার, কিছুক্ষণ গল্প, একটা আলতো জড়িয়ে ধরা—এটাই তো চাওয়া।

আগে যিনি শুধুই উপার্জন করতেন, এখন তিনি সন্তানের প্রথম বন্ধু, খেলায় সঙ্গী, জীবন শেখানোর পথপ্রদর্শক। যেসব বাবারা রান্নাঘরে ঢোকেন সন্তানের জন্য, বা রাতে ঘুম না এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্তানের পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন—তাঁদের গল্প ক’জন বলে? অথচ এই বাবারাই যুগ বদলে দিচ্ছেন নিঃশব্দ বিপ্লবের মতো।

রিকশাচালক বাবার স্বপ্নভরা সকাল

মোহাম্মদপুরের একটি ছোট ঘরে থাকেন শহীদ মিয়া। পেশায় একজন রিকশাচালক। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শহর চষে বেড়ান যাত্রী নিয়ে। প্রশ্ন করলে হেসে বলেন, “মেয়ে আমার মেডিকেলে পড়ে, আমি তো ওর বাবাই, পারলে সবই করে দিব।”

মেয়ের জন্য শহীদ মিয়া নিজের সব প্রয়োজন ত্যাগ করে দিনরাত খেটে যাচ্ছেন। ঈদে নিজের জন্য নতুন লুঙ্গি না কিনে মেয়ের জন্য পাঠান ব্র্যান্ডেড সালোয়ার কামিজ। অথচ কোনো অভিমান নেই, শুধু একটাই কথা—”সে যেন আমার চেয়ে বড় মানুষ হয়।”

অফিসার বাবার অসুস্থ ছেলেকে বাঁচাতে যুদ্ধ

গাজীপুরের ফয়সাল হোসেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মধ্যমপদে চাকরি করেন। তাঁর ছোট ছেলে রাহিন জন্ম থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত। একের পর এক হাসপাতালে ছুটে চলা, ঋণে জর্জরিত ফয়সাল আজও হাসিমুখে অফিস করেন, কারণ বলেন—”আমার চোখে পানি থাকলে ওর চোখে হাসি থাকবে না। সেটা আমি চাই না।”

তিনি যখন অফিসে কাজ করেন, একহাতে কম্পিউটার আর আরেক হাতে ছেলের চিকিৎসার কাগজপত্র। রাহিন এখন কিছুটা সুস্থ, কিন্তু বাবার যন্ত্রণা আজও অস্পষ্ট—একটু চাপা, একটু গোপন, ঠিক বাবাদের মতোই।

প্রবাসী বাবার একটিমাত্র চাওয়া

দুবাইয়ে ১৩ বছর ধরে কাজ করছেন রাজবাড়ীর আলমগীর হোসেন। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি তিন বছর, মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি স্কুলের প্রথম দিন থেকেই। হোয়াটসঅ্যাপে মেয়ে ছবি পাঠায়, আর তিনি ফেসবুকে সেই ছবি জুম করে চোখের সামনে ধরেন—মনে মনে বলেন, “তুই বড় হ। আমি তোকে ছুঁতে না পারলেও, তোকে দেখতে পাই, সেটাই অনেক।”
বাংলাদেশে কেউ তাঁকে চেনে না, তবে মেয়ের কাছে তিনি ‘হিরো’। তিনি চান না মেয়েটা বুঝে যাক, প্রবাসে কতটা কষ্ট হয় বাবার। তাঁর ভাষায়, “আমি যদি কাঁদি, ও কষ্ট পাবে। তাই হাসি। বাবারা এমনই।”

বাবারা কখনো গল্পের নায়ক হন না। কিন্তু বাস্তব জীবনের সবচেয়ে বড় নায়ক হয়েই থাকেন। তাঁরা চায় না বাহবা, চায় শুধু সন্তানের মুখের হাসি। বাবা দিবসে আসুন, আমরা একটু বেশি করে ভালোবাসি তাঁকে, একটু সময় দিই, আর সবচেয়ে বড় কথা—একটু অনুভব করি, তিনিও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।

বাবা দিবস শুধু একটি নির্দিষ্ট তারিখ নয়, এটি একটি উপলক্ষ—তাঁকে মনে করার, পাশে দাঁড়ানোর, জীবনের যেকোনো বয়সে তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরার। তাঁকে বলতে শেখার: “তোমার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না, কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমি সারা জীবন বয়ে নিয়ে যাবো।”

যখন সবাই ছেড়ে যায়, তখনো যিনি নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন—তিনি বাবা। ভালোবাসা তাঁর চিৎকার নয়, তা এক ধরনের নীরব প্রতিজ্ঞা: “তুমি পড়লে আমি ধরবো, তুমি থামলে আমি ঠেলবো, তুমি হারলে আমি জিততে দেবো।”

Leave a Reply

scroll to top