নতুন টাকায় কেন আবু সাঈদ-মুগ্ধের ছবি?

নতুন টাকায় কেন আবু সাঈদ-মুগ্ধের ছবি?
২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ ফারহানা হোসেন

২০২৪ সালের জুলাই। দেশের রাজপথে উত্তাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গুলিতে ঝরে যায় তরতাজা দুটি প্রাণ—রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ও ঢাকার তরুণ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। তাদের মৃত্যুই ‘জুলাই বিপ্লব’ নামক অধ্যায়ের সূচনা করে, যা আজো দগদগে স্মৃতি হয়ে আছে এই প্রজন্মের হৃদয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে, ঈদের পর বাজারে আসছে ৫ টাকার নতুন নোট, যেখানে থাকবে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের অবয়ব। আরও জানা গেছে, নতুন নোটগুলোর প্রতীকী ব্যবস্থায় তারুণ্য, ঐতিহ্য, সুন্দরবন, ধর্মীয় বৈচিত্র্যসহ দেশীয় ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ থাকছে। এটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমধর্মী এবং দৃষ্টান্তমূলক একটি উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানে আবেগের প্রতিচ্ছবি বেশি, না রাজনৈতিক কৌশলের ছায়া দীর্ঘ?

নতুন টাকায় কেন আবু সাঈদ-মুগ্ধের ছবি?

কে শহীদ, কে স্মরণীয়?

আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন আরও অনেকে। কিন্তু কেন শুধুই আবু সাঈদ ও মুগ্ধকে স্মরণে রাখা হলো? আবু সাঈদ প্রথম শহীদ, তাই হয়তো তার নাম ইতিহাসে অমলিন থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু মুগ্ধ? তার সঙ্গেই তো আরও অনেকে আহত বা নিহত হন। তাদের নাম আজ কোথায়? কে মনে রেখেছে?

সত্যি বলতে কী, আমরা একজনের জন্য আবেগে ভাসি, আর বাকিদের নামটুকুও মনে রাখি না। মুগ্ধের চেহারা, তার মায়াবী হাসি, আন্দোলনের সময় “পানি লাগবে, পানি!” বলে সামনে এগিয়ে যাওয়া—এসব ভাসিয়ে নিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। “এত সুন্দর একটা ছেলে, মারা গেল…”—এই বাক্যটাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে হাজারো ফেসবুক পোস্টে।

আমরা কি তার সংগ্রামটুকু মনে রেখেছি? নাকি শুধুই মুখটা?

আমাদের সমাজে আকর্ষণীয় চেহারা সহজে স্মরণীয় হয়ে যায়, জনপ্রিয় হয়ে যায়। গণমাধ্যম যেমন মুগ্ধের ছবিকে ‘ভাইরাল’ করেছিল, তেমনই বর্তমান সরকারও হয়তো সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে—একদিকে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে জনমনে জায়গা করে নেওয়া।

তবে প্রশ্নটা এখন তীব্র হয়ে ওঠে যখন দেখি—এক সময়ের সরকার বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখতে চেয়ে নতুন নোট মজুদ করেছিল, আর বর্তমান সরকার সেটি সরিয়ে অন্যদের ছবি যুক্ত করছে। উদ্দেশ্য যদি ছিল রাষ্ট্রীয় আদর্শ, তাহলে এই পরিবর্তনটাই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? আগেরটা যদি দলীয় পক্ষপাত হয়, তাহলে এখনকারটা নয় কেন?

নতুন টাকায় কেন আবু সাঈদ-মুগ্ধের ছবি?

নোট শুধু মুদ্রা নয়, বার্তা

ব্যাংকনোটে যে মুখ থাকে, তা শুধু ছবি নয়—তা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, সাংস্কৃতিক বার্তা এবং ইতিহাসের নান্দনিক প্রতিচ্ছবি। মুগ্ধ ও সাঈদের ছবি সেই দিক থেকে সম্মানজনক বটে। তবে একইসঙ্গে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে—শুধু চেহারা, জনপ্রিয়তা, আবেগ নয়; প্রকৃত ন্যায়বিচার, সমতা ও প্রতিনিধিত্ব কতটা প্রতিষ্ঠা করা গেল।

সকল শহীদের রক্তের রঙ এক। কারও পরিবারেই ক্ষতির ব্যথা কম নয়। কেউ মিডিয়ায় এলেন, কেউ থেকে গেলেন আড়ালে। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখ তো সমান হওয়া উচিত। সত্যিকার সম্মান তখনই হয়, যখন তা হয় সর্বজনীন, স্বচ্ছ এবং প্রাপ্যতা অনুযায়ী।

মতান্তরে কেউ এটিকে আবেগময় শ্রদ্ধা বলবেন, কেউ বলবেন ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট’ কাজে লাগিয়ে রাজনীতি। কেউ বলবেন এটি একটি distraction (বিভ্রান্তিকর)—অন্য কোথাও আলোচনার আগুন দপদপ করছে, তাই সবার মনোযোগ টেনে আনার এক চমৎকার কৌশল।

তবে যা-ই হোক না কেন, এ ঘটনাটি আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একটি কঠিন প্রশ্নের: আমরা কি আসলে ন্যায়বিচারের সমাজে বাস করছি? নাকি আবেগ ও সৌন্দর্যের রাজনীতিতে চালিত হচ্ছি?

নতুন টাকায় কেন আবু সাঈদ-মুগ্ধের ছবি?

শেষ কথাটি রইল আমাদের জন্যই…
আমরা যারা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী বলি, তারা নিজেরাও অনেক সময় পক্ষপাতমুক্ত থাকতে পারি না। আমাদের মূল্যায়নে মুখ-চেহারা, মিডিয়ার আলো, ফেসবুকের শোরগোল—সব কিছুই প্রভাব রাখে। আবু সাঈদ ও মুগ্ধের প্রতি সম্মান থাকুক। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখি, যারা আলোয় আসেননি, যারা কোনো ফটো পোস্ট বা ভাইরাল স্ট্যাটাস পাননি—তাদেরও ত্যাগ কম নয়। হয়তো বেশি।

এবারের ৫ টাকার নোট আমাদের শুধু নতুন ডিজাইন নয়, নতুন চিন্তা শেখাক। শেখাক ইতিহাস মনে রাখা, পক্ষপাত এড়িয়ে মূল্যায়ন করা, আর প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করার ন্যায়ের ভাষা।

Leave a Reply

scroll to top