১১ই মে ঘটা করে সারা পৃথিবী জুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব ‘মা দিবস’। এই দিনে আমরা দেখি মায়ের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসা। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। ১১ই এপ্রিল এই দিনটা আসলে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাকে নিয়ে কবিতা লিখে, কেউ বা লিখের মাকে ভালোবাসার গল্প। আবার কেউ কেউ মায়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে মা দিবসের শুভেচ্ছা জানায়।
একই সময়ে আবার আমাদের দেশে তথা পৃথিবীব্যাপী বৃদ্ধাশ্রম দিন দিন বেড়েই চলছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায় ‘মা পাগলের দেশে বৃদ্ধাশ্রম কেন?’ এই নিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভাবনা কী? এসব নানান বিষয় নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের সাথে কথা বলেছেন ২৪ঘন্টা বাংলাদেশ‘র রিপোর্টার নুরুল হাকিম বাপ্পি।
এ বিষয়ে কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ লাবিব জানান, ‘ মা-দিবসের উৎপত্তির দিকে যদি আমরা নজর দিই তাহলে দেখা যাবে ‘মা দিবস’ এসেছে পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে। এইটা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অংশ না।
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আঠারো শতকের পর থেকে দ্রুত শিল্পায়নের ফলে তাদের পরিবারগুলো হয়ে উঠেছিল একক পরিবার। এভাবে নগরায়ণের ফলে তারা নিজের লাইফ নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত যে তাদের পাশের বাসায় কে থাকে সেটা দেখারও সময় তাদের হয় না।
শিল্পায়নের যুগে নিজের ক্যারিয়ার, স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি নিয়ে তারা এতই ব্যস্ত হয়ে যায় যে একটা সময় গিয়ে তাদের বাবা-মায়ের প্রতি খেয়াল রাখার সময় হয়ে উঠে না কিংবা অনেকের হয়তো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজের বাবা-মাকে সময় দিতে পারে না। ফলে একটা সময় তাদের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। আমাদের দেশেও এখন নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠতেছে। সমাজের মানুষজনের একে অপরের সাথে দূরত্ব বাড়তেছে। নিজের ক্যারিয়ার, স্ত্রী-সন্তানকে সময় দিতে দিতে বাবা-মায়ের খুঁজ খবর রাখাটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের ঠাঁই হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।’
ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল ইভা বলেন,’ মা—এক আশ্চর্য শব্দ, যার মধ্যে লুকানো থাকে পৃথিবীর সমস্ত স্নেহ, ত্যাগ, আর নির্ভরতার গল্প।মা দিবসে আমরা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা-কে নিয়ে ভালোবাসার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি। কেউ কবিতা লেখে, কেউ ছবি দেয়, কেউ বা স্ট্যাটাস দেয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে—এই ভালোবাসাটা কি কেবল একটি দিনের?
বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র ১ দিন মা দিবস, বাকি দিনগুলো কি ‘উপেক্ষা দিবস’? আমাদের দেশের বহু মা বৃদ্ধ বয়সে ঠাঁই পান বৃদ্ধাশ্রমে। সমস্যাটা হলো—সমাজে লোক দেখানো সংস্কৃতিটা এতটা বেড়ে গেছে যে আমরা সত্যি আর ভন্ডামির ফাঁরাক বুঝতে পারি না। ভালোবাসা যদি সত্যিই থাকে, তাহলে সেটা প্রতিদিনের আচরণে প্রকাশ পায়। ভালোবাসা মানে শুধু “মা তোমায় ভালোবাসি” বলা নয়, বরং তাঁর পাশে থাকা, তাঁর প্রয়োজন বোঝা, তাঁর কথা শোনা, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে সময় দেওয়া।’
তিনি আরো বলেন, ‘ বর্তমানে মা দিবস যে ভালোবাসা মায়ের প্রতি প্রদর্শন করা হয় সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে তার অধিকাংশই স্রেফ লোক দেখানো। এর মধ্যে মায়ের প্রতি আমি ভালোবাসা দেখি না বরং দেখি সমাজের বাহবা পাওয়ার তাড়না, ভাইরাল হওয়ার নেশা আর বিকৃত মানষিকতা।’
আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় আহমেদ বলেন, ‘আমি একটা বাস্তব কাহিনী বলি, এলাকায় এমন একজনকে চিনি যে সকল বাবা দিবস, মা দিবস ফেসবুকে ধুম পালন করে! আপাতদৃষ্টিতে তার ফেসবুক অ্যাক্টিভিটিস দেখলে মনে হবে ছেলেটা বড্ড বাবা মা ভক্ত কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন! সে প্রতিনিয়ত তার মাকে দেখি বাজে শব্দ ব্যবহার করে গালি দিচ্ছে। এমন কি মা-কে মারধরের মতোই কাহিনি ঘটেছে বেশ কয়েকবার!
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর বাস্তব জীবন এক নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই লোক দেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করলেও তারা সত্যিকার অর্থে তাদের পিতা-মাতাকে ভালোবাসে না। এই মা দিবসে শুধু এটুকুই চাওয়া মাকে নিয়ে আমরা যে আবেগ ভালোবাসা ফেসবুকে প্রকাশ করি তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও সেই ভালোবাসা যেনো বাস্তব জীবনে মায়েদের প্রতি প্রদর্শন করি। কোনো মায়ের শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমের মতো জেলখানা না হোক।’
আইন বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী মেহেরুন্নেছা আশা জানান,’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা যে মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা দেখি তার অধিকাংশই মেকি, নিছক লোক দেখানো। বর্তমানে আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা চলে এসেছে। সবাই এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামেলি পছন্দ কতেছে যেখানে বাবা-মায়ের স্থান হয় না অনেক সময়। এছাড়াও বর্তমানে জেন-জি’রা বিলাসী জীবন-যাপনের জন্য কিংবা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। যারা বিদেশে যায় তারা খুব কম-ই দেশে ফিরে আসে। আর এদিকে তাদের বাবা-মায়েরা নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একটা সময় তারা নিঃসঙ্গতার আঁধার কাটাতে পাড়ি জমায় বৃদ্ধাশ্রমে।’