৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমে কথা বললেন ওবায়দুল কাদের।
সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য ওয়াল’-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কীভাবে আন্দোলনকারীরা তাকে নিজেদের শার্ট পরিয়ে, লাল পতাকাসংবলিত ব্যাজ এবং কালো মাস্ক পরিয়ে সংসদ এলাকা থেকে গণভবন অভিমুখী বড় রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যায়।
ওবায়দুল কাদের জানান, সেদিন তার বেঁচে থাকার কথা ছিল না, তিনি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি ছিলেন। নিজের সংসদ এলাকার বাসা এড়িয়ে তিনি পার্শ্ববর্তী একটি বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, কারণ তখন চারদিক থেকে মিছিল আসছিল এবং তা মূলত প্রধানমন্ত্রীর (সাবেক) গণভবন কেন্দ্রিক ছিল।
তিনি বলেন, “আমরা অবাক হলাম যে, সংসদ এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে মিছিল এবং একটা ‘লুটপাটের লুম্পেন স্টাইল’-এ কতগুলো ঘটনা ঘটে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের লোক আসে এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগই মনে হয়েছে- এটা কোনো রাজনৈতিক অভ্যুত্থান নয়, এটা ‘লুটপাটের অভ্যুত্থান’।”
আশ্রয় নেওয়া বাসাতেও আন্দোলনকারীরা হামলা চালায় উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আমি যে বাসাটায় ছিলাম, তারা সে বাসাতেও হামলা করে। তারা জানত না, যে সেখানে আমি আছি। আমার বাসা তারা ‘লুটপাট’ করেছে, কিন্তু যে বাসায় আমি গিয়ে আশ্রয় নিলাম, সেখানে হামলা করবে আমি ভাবতে পারিনি।”
তিনি বর্ণনা করেন, “আমার আশ্রয় নেওয়া বাসায় অনেক লোকজন ঢুকে পড়ে এবং ভাঙচুর ও ‘লুটপাট’ করতে থাকে। আমি আমার স্ত্রীসহ বাথরুমে প্রায় ৫ ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলাম। এরপর একটা পর্যায়ে তারা বাথরুমে ভেতরেও কমোড-বেসিন এগুলো ‘লুটপাট’ করেছে।”
ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী তখন বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা জোরপূর্বক ঢোকার হুমকি দিলে, তিনি স্ত্রীকে দরজা খুলে দিতে বলেন। ৭-৮ জন যুবক ভেতরে ঢুকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে, “নেত্রী তো চলে গেলেন, আপনি যাননি কেন?”
এরপরই ঘটে এক নাটকীয় পরিবর্তন। ওবায়দুল কাদের জানান, আচমকাই তাদের আচরণ পাল্টে যায়। একজন বলে, “আপনার ছবি তুলব”, এবং এরপর শুরু হয় ছবি তোলা ও সেলফি তোলা। তিনি ধারণা করেন, এদের মধ্যে অনেকেই তাকে চিনতো।
ঠিক কী কারণে তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাব হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল, তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। তাদের মধ্যেই একটি গ্রুপ তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল, আবার কেউ কেউ চেয়েছিল জনতার হাতে তুলে দিতে। এই পরিস্থিতি তার মনে গভীর চাপ সৃষ্টি করে।
অবশেষে, তারা তাকে একটি শার্ট, লাল পতাকাসংবলিত ব্যাজ এবং মুখে কালো মাস্ক পরিয়ে সংসদ এলাকা থেকে গণভবন অভিমুখী বড় রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। হঠাৎ কোথা থেকে একটি খালি ট্যাক্সি বা ইজি বাইক আসে, যা সেই মুহূর্তে রাস্তায় ছিল না। তিনি এটাকে তার ভাগ্য বলে মনে করেন।
ওবায়দুল কাদের জানান, তাদের মধ্যে দুজন তাকে ও তার স্ত্রীকে সেই গাড়িতে তোলে এবং পথে চেকপোস্ট ও লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে, “চাচা-চাচি অসুস্থ, হাসপাতালে নিচ্ছি, বিরক্ত করবেন না।” এভাবেই তারা তাকে অনেক দূরের একটি জায়গায় পৌঁছে দেয়।
এই অপ্রত্যাশিত সাহায্যের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “ভাবতেও পারিনি যে যারা কয়েক মিনিট আগে বাথরুমে জোর করে ঢুকেছিল, তারাই আমাদের এভাবে রক্ষা করবে। সেদিন বেঁচে যাওয়া ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। এটা ছিল পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”