শিশুর দাঁতের ক্ষয় রোধে করণীয়

New-Project-8.jpg
মুহাম্মদ নূরে আলম নিজস্ব প্রতিবেদক

শিশুদের দুধের দাঁত পড়ে যাবে এই ধারণায় অনেক অভিভাবক তাদের দাঁতের যত্নে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। দুধের দাঁতের স্বাস্থ্য শিশুর স্থায়ী দাঁতের গঠন ও স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। দুধের দাঁতের ক্ষয় শিশুর পুষ্টি গ্রহণ, কথা বলার ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাসের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শৈশব থেকেই দাঁতের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

দাঁতের ক্ষয় হয় কেন?

দাঁতের ক্ষয়ের প্রধান কারণ মুখে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার। শিশুরা যখন চকলেট, ক্যান্ডি, কেক, কোমল পানীয় বা অন্যান্য মিষ্টি খাবার নিয়মিত খায় এবং দাঁত পরিষ্কার না করে, তখন মুখের ব্যাকটেরিয়া (বিশেষ করে স্ট্রেপটোকক্কাস মিউটানস) খাবারের চিনির সঙ্গে মিশে অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যাসিড দাঁতের এনামেল (বাইরের শক্ত স্তর) ক্ষয় করে এবং ধীরে ধীরে দাঁতের গর্ত বা ক্যাভিটি তৈরি করে। এছাড়া, দাঁতের ফাঁকে খাবার আটকে থাকা, অপর্যাপ্ত ব্রাশ করা, এবং ফ্লুরাইডের অভাবও দাঁতের ক্ষয় বাড়ায়। শিশুদের দাঁতের এনামেল পাতলা হওয়ায় তারা এই সমস্যার প্রতি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

দাঁতের ক্ষয় রোধে করণীয়

শিশুর দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় সঠিক যত্ন এবং সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে কিছু তথ্যনির্ভর পদক্ষেপ দেওয়া হলো:
নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করানো
শিশুকে দিনে দুইবার—সকালে নাশতার পর এবং রাতে ঘুমানোর আগে—দাঁত ব্রাশ করানো অত্যন্ত জরুরি। দুই বছর বয়সের পর থেকে শিশুদের জন্য ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে পরিমাণ হতে হবে অল্প, প্রায় একটি মটরশুঁটির আকারের সমান। ফ্লুরাইড দাঁতের এনামেলকে শক্তিশালী করে এবং ক্ষয় রোধে সহায়তা করে। শিশুদের জন্য নরম ব্রিস্টলের টুথব্রাশ ব্যবহার করুন এবং প্রতি তিন মাস পর পর ব্রাশ পরিবর্তন করুন।

চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় নিয়ন্ত্রণ
চকলেট, ক্যান্ডি, কেক, কোমল পানীয় এবং ফলের রসে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে, যা দাঁতের ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুদের এই ধরনের খাবার সীমিত পরিমাণে এবং নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ানো উচিত। খাওয়ার পরপরই দাঁত ব্রাশ করানো বা কমপক্ষে পানি দিয়ে কুলি করানো জরুরি। এছাড়া, চিনিমুক্ত চুইংগাম (যদি শিশু চিবাতে পারে) ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ এটি লালার নিঃসরণ বাড়ায়, যা দাঁত পরিষ্কার রাখতে সহায়ক।

শিশুকে দাঁতের যত্নে অভ্যস্ত করা
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই দাঁতের যত্নের গুরুত্ব বোঝানো প্রয়োজন। তিন বছর বয়স থেকে তাদের নিজে নিজে ব্রাশ করতে শেখানো যেতে পারে, তবে অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে। শিশুদের বোঝানো উচিত যে দাঁত পরিষ্কার না রাখলে ব্যথা, গর্ত বা দাঁত পড়ে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে। রঙিন টুথব্রাশ বা ফলের স্বাদযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করে ব্রাশ করাকে মজাদার করে তুলুন। এছাড়া, দাঁতের যত্নের গল্প বা ভিডিও দেখিয়ে তাদের আগ্রহী করে তুলতে পারেন।

নিয়মিত দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ
প্রতি ছয় মাস অন্তর দন্ত চিকিৎসকের কাছে শিশুকে নিয়ে যাওয়া উচিত। চিকিৎসক দাঁতের প্রাথমিক ক্ষয় বা অন্যান্য সমস্যা শনাক্ত করতে পারেন, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। প্রয়োজনে ফ্লুরাইড ট্রিটমেন্ট বা সিলান্ট প্রয়োগের মাধ্যমে দাঁতের ক্ষয় রোধ করা যায়। বাংলাদেশে দন্ত চিকিৎসকের সংখ্যা সীমিত হলেও, সরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি ক্লিনিকে এই সেবা পাওয়া যায়।

রাতে দুধ খাওয়ার পর সতর্কতা
অনেক শিশু রাতে ঘুমানোর আগে বোতলে বা গ্লাসে দুধ খায়। দুধে থাকা প্রাকৃতিক চিনি (ল্যাকটোজ) দাঁতে লেগে থেকে ক্ষয় সৃষ্টি করতে পারে, যা ‘বেবি বোতল টুথ ডিকে’ নামে পরিচিত। দুধ খাওয়ানোর পর শিশুকে একটু পানি পান করানো বা দাঁত ব্রাশ করানো উচিত। শিশু যদি বোতলে দুধ খায়, তবে দীর্ঘ সময় ধরে বোতল মুখে রাখতে দেওয়া উচিত নয়।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
শিশুদের ফলমূল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত পণ্য এবং ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়ানো উচিত। এই খাবারগুলো দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং ক্ষয়ের ঝুঁকি কমায়। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস সমৃদ্ধ খাবার, যেমন দই বা পনির, দাঁতের এনামেলকে শক্তিশালী করে। এছাড়া, পর্যাপ্ত পানি পান করানো মুখের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৬০-৯০% শিশু দাঁতের ক্ষয়ে ভোগে। বাংলাদেশে শিশুদের দাঁতের স্বাস্থ্য নিয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে দন্ত চিকিৎসকের সংখ্যা কম এবং অভিভাবকদের মধ্যে দাঁতের যত্ন নিয়ে ভুল ধারণা প্রচলিত। তাই স্কুল ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতা প্রোগ্রাম চালানো জরুরি। এছাড়া, শিশুদের দাঁতের ক্ষয় রোধে সরকারি পর্যায়ে ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট সরবরাহ এবং স্কুলে দাঁতের যত্নের শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
শিশুর দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা শুধু দাঁতের জন্য নয়, সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে যত্ন নিলে দাঁতের ক্ষয়, ব্যথা এবং জটিল চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কমে যায়। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের দাঁতের যত্নে সচেতন হওয়া এবং সুস্থ অভ্যাস গড়ে তোলা

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট, নয়াদিগন্ত, বিজনেস মিরর এবং শিরোনাম মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে সাব-এডিটর ও কনটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এনভিডিয়া ও দুবাই ওয়ান মিলিয়ন প্রমপ্টার্স থেকে জেনারেটিভ এআই ও প্রমপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সনদপ্রাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠকবান্ধব, প্রাসঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম কনটেন্ট তৈরিতে তার দক্ষতা অনন্য। ব্যবসা, প্রযুক্তি, সমাজ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখিতে তার পারদর্শিতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘স্বপ্নবাজ ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘রেঁনেসা ফাউন্ডেশন’-এর মিডিয়া প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

scroll to top