অপরিশোধিত পানি সংকটে নাগরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ওয়াসার দায়িত্বহীনতা

ওয়াসার দায়িত্বহীনতা
মুহাম্মদ নূরে আলম মুহাম্মাদ নূরে আলম, গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুর, তেজগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মধুবাগ, বাসাবো, মানিকনগর, খিলগাঁও তিলপাপাড়া, তারাবাগসহ বেশ কিছু অভিজাত ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে পোকা ও অজানা জীবাণুযুক্ত বস্তু পাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এসব এলাকায় সরাসরি ব্যবহৃত পানিতে লালচে, কালচে, কখনোবা সাদা রঙের আধা ইঞ্চি দীর্ঘ বিভিন্ন ধরনের লার্ভা, পোকা ও অনুচ্চার্য বস্তু দেখা যাচ্ছে—যা নাগরিক জীবনে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির বার্তা বহন করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নাগরিক কল্যাণকেন্দ্রিক সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াসার এ ধরনের ব্যর্থতা শুধু দায়িত্বহীনতাই নয়, এটি এক ধরনের নৈতিক ও মানবিক ব্যর্থতাও।

যে পানি দিয়ে প্রতিদিন মানুষ রান্না করে, শরীর ধোয়, দাঁত মাজে এবং প্রয়োজনীয় সব কাজ সম্পন্ন করে—সে পানিতে যদি জীবাণু, লার্ভা ও পোকামাকড় থাকে, তাহলে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের মৌলিক নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করছে? নাগরিকেরা নিয়মিত পানির বিল পরিশোধ করছেন, অথচ তারা পাচ্ছেন না ন্যূনতম পরিষ্কার ও নিরাপদ পানি। এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ওয়াসার দায়সারা বক্তব্য এবং সমস্যাকে ট্যাংক পরিষ্কারের দায়ে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। কল্যাণপুরের মসজিদ গলি এলাকার বাস্তবতাই যথেষ্ট প্রমাণ করে—ট্যাংক পরিষ্কার করিয়েও বহু পরিবার পানি থেকে পোকা মুক্ত হতে পারেনি। এমনকি বহুবার অভিযোগ জানানোর পরও ওয়াসার কর্তৃপক্ষ প্রতিকারমূলক কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, যা একপ্রকার চরম প্রশাসনিক উদাসীনতা।

এক্ষেত্রে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, যেসব এলাকায় দেখা যাচ্ছে লাল কেঁচোর মতো বা সুতার মতো লার্ভা, যেমন মুগদা, খিলগাঁও, তিলপাপাড়া—সেসব সমস্যা শুধুমাত্র ভবনের পরিচ্ছন্নতার ঘাটতির কারণে নয়, বরং এটি একটি অন্তর্নিহিত প্রযুক্তিগত ও কাঠামোগত ত্রুটির নির্দেশ করে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের দিকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যা এই সংকটের উৎস সম্পর্কে একটি প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেয়।

ঢাকার মতো একটি শহরে—যেখানে স্বাস্থ্য, আবাসন, স্যানিটেশন ও নগরব্যবস্থাপনার ওপর চরম চাপ রয়েছে—সেখানে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় এই ধরনের বিপর্যয় একটি গণস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিতে বাধ্য। এই সমস্যা কেবল পানির মান বা প্রযুক্তির ত্রুটি নয়, এটি একটি গভীর প্রশাসনিক ব্যর্থতা, যার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন লাখো সাধারণ মানুষ।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষের উচিত এখনই এই সংকটকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধানে এগিয়ে আসা। প্রথমত, আক্রান্ত এলাকাগুলোর পানি সরবরাহে জরুরি ভিত্তিতে জল নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, পানি শোধনাগারসমূহের কার্যক্রমে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তিগত পর্যালোচনা চালাতে হবে। তৃতীয়ত, প্রতিটি এলাকায় ওয়াসার স্থানীয় অফিসগুলোকে সচল করে অভিযোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও জোরদার করতে হবে। জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন আইইডিসিআর বা জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার মাধ্যমে এর উৎস ও ঝুঁকি চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের রূপরেখা নির্ধারণ জরুরি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সংকটকে গা-সওয়া অভ্যাসে পরিণত না করা। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণআস্থার ভিত্তি ভেঙে পড়বে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার সংকট। তাই দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ।

ঢাকার নাগরিকেরা আর কোনো ‘তালবাহানা’ নয়, চায় নিরাপদ পানি—এবং সেই দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকারের উচিত সর্বশক্তি নিয়োগ করা, যাতে স্বাস্থ্য, সেবা ও সম্মান—এই তিনটি নাগরিক অধিকার একত্রে রক্ষা পায়। প্রতিটি দিনের দেরি কেবলই সংকটকে আরও গভীর করে তুলবে। তাই এখনই সময়, সংকটকে স্বীকার করে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তা নিরসনে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার।

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

scroll to top