চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটার দাবি অস্বীকার করলেও, নিয়োগপত্রে রয়েছে পরিষ্কার সুপারিশ; ঠিকাদার হয়রানি ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে

‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা সনদে বিসিকে চাকরি!

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়েছেন বিসিক প্রকৌশলী কামরুজ্জামান। উঠেছে দুর্নীতি, ঠিকাদার হয়রানি ও কোটি টাকার আত্মসাতের অভিযোগ।
মুহাম্মাদ নূরে আলম খান শান্ত, ঢাকা

পর্ব-০২

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বরিশাল জেলা কার্যলয়ের সহকারী প্রকৌশলী এ.কে.এম কামরুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পান। তবে তার বাবা মৃত ইমারত হোসেন খান ওরফে ইমারত মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাই নন বলে অভিযোগ তুলেছেন, তার গ্রামের আশেপাশের মানুষজন এবং তিনি যাদের সহযোদ্ধা হিসেবে বলে গেছেন তারাই।

ইমারত মোল্লার ভাই লিয়াকত মোল্লা যুদ্ধের সময় গুলি লেগে মারা যান সেই সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ পরিবার হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ আছে। মৃত ইমারত হেসেনকে ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বহুবার এই অভিযোগ উপজেলা পর্যন্ত এলেও কোনো তদন্তই করা হয়নি। তবে এ.কে.এম কামরুজ্জামানের দাবি, তিনি কোটায় নয়, মেধায় চাকরি পেয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ.কে.এম কামরুজ্জামান ও তার ভাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পেলেও এখন আর এ.কে.এম কামরুজ্জামান সেই তথ্য স্বীকার করছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নয়, নিজের মেধায় চাকরি পেয়েছি। কোটার প্রয়োগটা শুধুই ফরমালিটি (আনুষ্ঠানিকতা) ছাড়া আর কিছু না। আমার বাবার ভারতীয় তালিকায় নাম নেই। সে হিসেবে লাল মুক্তিবার্তাকে রেফারেন্স হিসেবে ধরেই কর্তৃপক্ষ সব ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করে আমাকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়।’

তবে তার নিয়োগ বোর্ডের নির্বাচনী কমিটির সভার কার্যবিবরণীর প্রথম ও দ্বিতীয় পাতায় নির্বাচনী কমিটির আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও দুজন সদস্য তাকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি দেওয়ার সুপারিশ করে স্পষ্টভাবে স্বাক্ষর করেছেন।

পর্ব-০১ বিসিক প্রকৌশলী কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ 

বিসিকের বরিশাল জেলা কার্যলয়ের সহকারী প্রকৌশলী এ.কে.এম কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে ঠিকাদারদের হয়রানি, আত্মীয় স্বজনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি ব্যবসা, নিয়োগ, তদবির, বদলি বাণিজ্য এবং বিগত আওয়ামীলীগের বিভিন্ন নেতার নাম ভাঙিয়ে তার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ।

দুর্নীতির টাকায় উত্তরা ও পূর্বাচলে স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ী ও আত্মীয়দের নামে প্লট ও ফ্লাট কিনেছেন কামরুজ্জামান। দুর্নীতির টাকা বৈধ করতে দেশের বাড়ি ফরিদপুরে ডেইরী ফার্ম, পোল্ট্রি ফার্ম’র ব্যবসা করছেন। নিজ এলাকা ও শ্বশুরবাড়িতে কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন অল্প সময়ের মধ্যে। ফরিদপুর শহর ও তার আশেপাশে রয়েছে তার স্ত্রী ও শশুরবাড়ির লোকজনের নামে কয়েকটি প্লট ও বাড়ি।

মাদারীপুরের এক ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, মাদারীপুর নতুন বিসিক এরিয়ার বিভিন্ন কাজে রিভাইজ করিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কামরুজ্জামান। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবে সাবেক একজন ডিআইজির ভাগিনা সাবেক নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান, তার ছেলে আসিব খান, শাজাহান খানের ভাই যাচ্চু খান, সাবেক বিসিক প্রধান প্রকৌশলী ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন মেজর জেনারেলের নাম ভাঙিয়েছেন তিনি।

অভিযোগে জানা গেছে, মাদারীপুর বিসিক নগর তৈরির সময় শাজাহান খানের ভাইয়ের সার্বির ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে যোগসাজে সরকারি অর্থ ভাগাভাগি করেছেন কামরুজ্জামান। এছাড়া শাজাহান খানের চাচাতো ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক খানের সাথে তার ছিল ভালো বন্ধুত্ব। শফিক খান বিভিন্ন জনকে হাসির ছলে বলতেন তারা দুইজন গ্লাস ও নারীর পার্টনার।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের একটি তালিকা এরই মধ্যে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বাস্তবিক অর্থে কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি পেয়ে থাকলে আইনগতভাবেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হবে।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের পরিচালক (প্রশাসন) কাজী মাহবুবুর রশিদ বলেন, ‘এমন অভিযোগ এলে বিভাগীয় তদন্ত হবে। এরপর প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’

জানা যায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বেশ কয়েকটি সনদ। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিবার্তা, কল্যাণ ট্রাস্ট ও বেসামরিক গেজেট; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এই তিন তালিকার মধ্যে মৃত ইমারত হোসেনের নাম সংযুক্ত রয়েছে শুধু মুক্তি বার্তায়, যার নম্বর ০১২৯০০০৪৩০৮ ।

এ বিষয়ে এ.কে.এম কামরুজ্জামান বলেন, তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তবে আমি ডিটেইল বলতে পারবো না। তারকাছে যুদ্ধের সময় তার বাবার কয়েকজন সহযোদ্ধার কথা জানতে চাইলে তিনি উত্তিজিত হয়ে যান। পরে নিজেকে অসহায় এবং নির্দোষ দাবি করে শিপলু নামের একজনকে দিয়ে ফোন দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সংবাদটি না করার অনুরোধ জানান এ.কে.এম কামরুজ্জামান।

Leave a Reply

scroll to top