রাজধানীতে অপরাধ চক্রের সহিংস তাণ্ডব: ৫ মাসে ৫৬ খুন

New-Project-2025-06-16T132859.430.png
নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) রাজধানী ঢাকায় ১৬৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি, অর্থাৎ ৫৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে অপরাধী চক্রগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পত্তি দখলের মতো বিষয়গুলোই এসব হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বেশিরভাগ ঘটনাই পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে পলাতক সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।

ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে সন্ত্রাসী চক্রগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, যা রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে গুরুতর অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতাও তৈরি হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী চক্রের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগও রয়েছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ সন্ত্রাসীই এখনও অধরা।

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের চিত্র

গত দুই মাসের ব্যবধানে বাড্ডায় দুইজন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী গুলিতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৫ মে বাড্ডায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডারত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। এর আগে, ২০ মার্চ গুলশানের পুলিশ প্লাজার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বাড্ডার আরেক ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সুমন মিয়াকে। র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডার পলাতক সন্ত্রাসী মেহেদী ও রবিন গ্রুপের মধ্যে চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে সুমনকে খুন করা হয়েছে।

ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে রাজধানীতে ১৬৮টি খুনের মধ্যে ৫৬টিই ঘটেছে চাঁদাবাজি, ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা ও সম্পত্তি দখলকে কেন্দ্র করে। ডিএমপির ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের তথ্য আরও বিস্তারিতভাবে দেখায় যে, এই ৫৬টি হত্যার নেপথ্যে রয়েছে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, অক্সিজেন সরবরাহ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাঁচামাল সরবরাহ, নির্মাণসামগ্রী, বিশুদ্ধ পানির ব্যবসা, ফুটপাত ও মার্কেট থেকে চাঁদা আদায়, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বাজার ও টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ সংযোগ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়নকাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ। এসব খাতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা নিয়ন্ত্রণ নিতেই এসব খুনের ঘটনা ঘটছে।

ডিএমপির প্রায় সব থানা এলাকাতেই এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সূত্রাপুর, লালবাগ, চকবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, তুরাগ, বাড্ডা, উত্তরা, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ এবং শ্যামপুর উল্লেখযোগ্য। পুলিশের তদন্ত ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, অনেক ক্ষেত্রে হত্যার আগে ভুক্তভোগীরা একাধিকবার হুমকি পেয়েছেন।

গত ২১ মে লালবাগে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী রাসেল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে ব্যবসার ভাগাভাগি নিয়ে স্থানীয় প্রতিপক্ষ চক্রের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোই রাসেলের জন্য কাল হয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করলেও এখনো অধরা রয়ে গেছে মূল পরিকল্পনাকারীরা।

এপ্রিলে কামরাঙ্গীরচরের খালপাড় এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণকারী রফিকুল ইসলাম খুন হন। অভিযোগ উঠেছে যে, স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা একটি গ্রুপ অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিল।

তদন্তে জটিলতা

ডিএমপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটে কিছু রাজনৈতিক নেতা, তাদের অনুসারী, ঠিকাদার এবং সন্ত্রাসী জড়িত রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব চক্র থানা-পুলিশকে নিজেদের প্রভাবে বা অর্থের বিনিময়ে ‘ম্যানেজ’ করে রাখে। এ কারণে থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে এসব চক্রের বিপক্ষে হত্যা মামলা নিতে গড়িমসি এবং বাদীকে ভয় দেখানোর অভিযোগও উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু লোককে স্পর্শ না করার চাপ তাদের ওপর থাকে এবং খুনের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যাহত হয়।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ১০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত বাহিনীর পরিচয়ে ২০-২৫ জন চাঁদাবাজ মিরপুরের স্বাধীন মার্কেটে ভাঙচুর চালায় এবং ব্যবসায়ীদের হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় মামলার পর পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পল্লবীতে ২০ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, ডিশ ও ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে মঞ্জুরুল ইসলাম বাবু ওরফে ব্লেড বাবুকে খুন করে আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার (মিরপুর ও তেজগাঁও) মিজানুর রহমান জানান, বিভিন্ন দ্বন্দ্বের জেরে পল্লবীর সন্ত্রাসী রাজন গ্রুপ মঞ্জুরুলকে খুন করে। এ ঘটনায় মঞ্জুরুলের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার পল্লবী থানায় মামলা করার পর রাজন গ্রুপের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার অনেক সন্ত্রাসী পরে জামিনে মুক্তি পাচ্ছে। তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা এবং দুর্বলতার অভিযোগও উঠছে, আর অনেকে আবার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে। এসব কারণে অপরাধীরা আবারও অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার ৪২৬ জন আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

রণদা প্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও মানবাধিকার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী লতিফুর রেজা বলেন, “রাজধানীর গত পাঁচ মাসের ওই খুনগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধ নয়, এগুলো একটি সংঘবদ্ধ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেটে রূপ নিচ্ছে। রাষ্ট্র যদি এই অবস্থার লাগাম এখনই না ধরে, ভবিষ্যতে এটি আরও বিপজ্জনক রূপ নেবে।”

তিনি আরও যোগ করেন, ঢাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন ব্যবসা ও সেবা খাত বাড়ছে, যেগুলোর বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে সশস্ত্র ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খুনের মতো জঘন্য অপরাধে বারবার ফিরে আসছে এই চক্রগুলো।

তবে ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলেছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কোনো অপরাধী আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

Leave a Reply

scroll to top