ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা: মুসলিম একতাই আনতে পারে বিজয়

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে। মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যই হতে পারে শান্তি ও বিজয়ের একমাত্র পথ।

ছবি: এআই/মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

এই আগ্রাসন থামাতে এখনই বিশ্বকে এক হতে হবে। নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরছে, আর বিশ্ব নেতারা চুপ করে আছে। এই নীরবতা ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আমরা গাজা, তেহরান, বেইরুত, দামেস্ক এবং সানা—সব নিপীড়িত জনগণের পাশে আছি।

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাত বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুরু থেকেই এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে চেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার দুই দফা পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও এই দাবির কোনো প্রমাণ নেই, তবু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে।

নেতানিয়াহু ও তার উগ্রপন্থী সহযোগীরা শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা নিয়ে ইরানের ইসলামিক শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছেন। প্রথম দিনের হামলা কিছুটা সফল হলেও, ইরান পাল্টা হামলা চালিয়ে পরিস্থিতি বদলে দেয়। ইরানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, আবার ইসরাইল রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জি-৭ বৈঠক শেষ না করেই হোয়াইট হাউসে ফিরে যান। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জরুরি বৈঠকের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন এবং ইসরাইলের সঙ্গে মিলে তেহরান খালি করার নির্দেশ জারি করেন।

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপে আমেরিকার মধ্যেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে ফেলছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে পৃথকভাবে বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে ট্রাম্প কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়াতে না পারেন। আটজন মার্কিন সিনেটর এই বিল পেশ করেছেন। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স নেতানিয়াহুর তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, “ইরানের ওপর হামলা করে নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ শুরু করেছেন। তিনি ইরানের প্রধান পারমাণবিক আলোচক আলী শামখানিকে হত্যা করে মার্কিন-ইরান পারমাণবিক আলোচনা ভণ্ডুল করেছেন। আমেরিকাকে নেতানিয়াহুর আরেকটি অবৈধ যুদ্ধে জড়ানো উচিত নয়।”

একইভাবে, কংগ্রেস সদস্য থমাস ম্যাসি ‘যুদ্ধ ক্ষমতা রেজুলিউশন’ নামে একটি বিল পেশ করছেন, যা মার্কিন সামরিক সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করবে। মার্কিন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা ৬৯ শতাংশ। ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তিনি নেতানিয়াহুর উসকানিতে সাড়া দিচ্ছেন। নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যা করলে সংঘাত শেষ হবে এবং ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে ‘পূর্ণ বিজয়’ অর্জন করবে। তিনি এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি।

ট্রাম্প একদিকে তেহরান খালি করার নির্দেশ দিয়ে নেতানিয়াহুর সুরে কথা বলেছেন। অন্যদিকে, তিনি ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি ও ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। তবে এই যুদ্ধবিরতির শর্ত ইরানের কাছে আত্মসমর্পণের মতো। তাই তেহরান এতে সম্মত হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। ইরানের নেতৃত্ব বুঝতে পারছে যে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করতে চায়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক ভাষণে বলেছেন, তিনি দেশের জন্য শাহাদত বরণ করলেও ইসলামী বিপ্লব ও ইরানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই চলবে।

কানাডায় জি-৭ বৈঠকে ইসরাইলের ইরান হামলাকে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ হিসেবে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। তবে তুরস্ক, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ শীর্ষ মুসলিম দেশ ও ওআইসি ইরানে ইসরাইলি হামলার নিন্দা করেছে। চীন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, “বিশ্ব নেতাদের নীরবতা লজ্জাজনক। নেতানিয়াহুকে আটকাতে হবে। আমরা লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানের জনগণের পাশে আছি।”

নেতানিয়াহু বলেছিলেন, এই যুদ্ধ দুই সপ্তাহ চলবে। কিন্তু ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরাইল বিপর্যস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের প্রত্যাঘাত অব্যাহত থাকলে ইসরাইল যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে। তবে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা ইরানের শাসন পরিবর্তনের। তিনি ইরানিদের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ক্ষমতাচ্যুত রাজা রেজা শাহ পাহলভির ছেলে রেজা পাহলভিকে ইসরাইল ডেকে নিয়েছে। পাকিস্তানে বালুচ বিদ্রোহী ও কুর্দি অঞ্চলের ইরানিদেরও বিদ্রোহে উসকানো হচ্ছে।

তেহরানে ইরানি পুলিশ একটি গোপন ড্রোন কারখানা আবিষ্কার করেছে, যেখানে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তত্ত্বাবধানে নাশকতার জন্য ড্রোন তৈরি হতো। যুদ্ধের প্রথম দিনে ইসরাইল ছয় জেনারেল ও সমসংখ্যক পারমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে। পরবর্তী দিনগুলোতে ড্রোন ব্যবহার করে সামরিক ও সরকারি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গোষ্ঠী সক্রিয়, যাদের পশ্চিমা দেশ ও ইসরাইল সমর্থন দেয়। এর মধ্যে রয়েছে পাহলভি রাজাদের সমর্থক, মুজাহিদীনে খালক বা কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যেমন বালুচ ও কুর্দিরা। এই গোষ্ঠীগুলোকে ইসরাইল ও তার মিত্ররা শাসন পরিবর্তনের জন্য উসকানি দিচ্ছে।

ইসরাইল গত এক বছর ধরে ইরানে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে জানিয়েছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইল গাজাকে ধ্বংস করে। এরপর লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি ও সিরিয়ার আসাদ সরকারকে টার্গেট করে। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনার মধ্যেই ইসরাইল সর্বাত্মক হামলা চালায়।

ইরানের পাল্টা হামলায় তেল আবিব, হাইফা বন্দর, নেগেভ বিমানঘাঁটি ও পারমাণবিক কেন্দ্রে আঘাত হানা হয়েছে। ইরান যদি এই প্রত্যাঘাত অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে ইসরাইল যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে বাধ্য হতে পারে। তবে নেতানিয়াহুর লক্ষ্য বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা। এজন্য তিনি মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলোকে দুর্বল করে চলেছেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধ, আরব বসন্ত, লিবিয়ার বিভক্তি, সিরিয়া ও ইয়েমেনের অস্থিরতা—এসবের পেছনে ইসরাইল ও তার মিত্রদের ভূমিকা ছিল।

আরব দেশগুলো ইসরাইলের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে জানে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা তাদের নেই। ইরান এ ক্ষেত্রে ছিল শীর্ষে। ইরান যদি এই যুদ্ধ সামলাতে পারে, তাহলে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। ইরান ইতোমধ্যে পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোকে সামরিক জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।

এই সঙ্কট শুধু মুসলিম দেশগুলোর নয়, পুরো বিশ্বব্যবস্থার। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে জাতিসঙ্ঘ ও এর প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন কমিয়ে দিয়েছেন। শক্তির জোরে দেশ দখলের বিরুদ্ধে বিকল্প ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি ব্রিকস ও মধ্যশক্তির দেশগুলো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

scroll to top