সময়টা সম্ভবত ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ২০০৯ কিংবা ১০ সাল। বয়স তখন ১০ কি ১১ হবে। তখন রামগঞ্জ উপজেলার দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া নামক এক কওমি মাদরাসায় পড়তাম। একদিন মাদরাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ করেই পেছন থেকে হুজুর এসে বেত দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলেন। কোনো কারণ বুঝে উঠতে পারলাম না। বেত্রাঘাতে শরীরের কয়েকটি জায়গায় ব্যথা আর ফোলাভাব হয়ে গেছে, যেন ছাপ ফেলে গেছে মনেও। দুপুর গড়িয়ে বিকেল—এক বন্ধু (সহপাঠি) এসে বলল, “চল পালাই, আর পারছি না!” আমি কিছু না ভেবেই ওর কথায় সায় দিলাম।
সন্ধ্যার পর এক কাপড়ে আমরা মাদরাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য—ঢাকা। কি করবো ঠিক মাথায় নেই, তবে এতটুকু জানি আর পড়া হবে না। পকেটে সামান্য কিছু টাকা, আর বুকভরা রাগ-অভিমান।
রামগঞ্জ থেকে কুমিল্লা কোর্টবাড়ি গিয়ে একটা মসজিদে রাত কাটালাম। ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রাকের ড্রাইভারের পাশের সিটে চড়ে ঢাকার পথে রওনা হলাম। এসে নামলাম রাজধানীর সায়েদাবাদে। সেখান থেকে চলে এলাম মৌচাকে। এরপর বন্ধুর পরিচিত এক লোকের দোকানে উঠি। কথা হয়, উনি যে কোনো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবেন।
অন্যদিকে, মাদরাসায় না পেয়ে সন্ধ্যার পরপরই কর্তৃপক্ষ আমার বাড়িতে খবর দেয়। শুরু হয় আমার খোঁজ। ততক্ষণে আমি ব্যস্ত শহর রাজধানী ঢাকায়। মা-বাবার অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো পরিবারজুড়ে। গোটা জেলায় মাইকিং হয়। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয়—টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
আমার আব্বু তখন কাতার প্রবাসী। আমার হারিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েই সব ফেলে ইমার্জেন্সি ছুটি নিয়ে রওনা হন দেশে। উদ্দেশ্য হারানো ছেলেকে খুঁজে বের করবেন।
এদিকে, ঢাকায় যেই দোকানে উঠি, সেখানকার পরিবেশে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল। একের পর এক অপরিচিত মানুষ আমাদের দেখতে আসছে, কেউ দাঁড়িয়ে থাকছে, কেউ চোখে চোখ রাখছে। এ দৃশ্য দেখে ভয় আর সন্দেহে মন কাঁপতে শুরু করেছে।
মোবাইল ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করে মনে পড়লো আম্মুর এবং ফুফাতো ভাইয়ের (পারভেজ) নাম্বার আমার মুখস্ত। তবে আম্মুকে ফোন দেওয়ার সাহস কখনোই আমার হবে না। কারণ পালিয়ে এসেছি। মাথায় বুদ্ধি আসে। পাশের এক বুটিক দোকানে ঢুকে ফুফাতো ভাইয়ের নম্বরে কল করি। তাঁকে আমার অবস্থান সম্পর্কে জানাই। তিনি সাথে সাথে খালাতো বোন রোকশানা আপুকে জানান, যিনি থাকতেন রাজধানীর মধ্য বাড্ডায়। সন্ধ্যার আলো নিভে যাবার আগে আমার দেওয়া ঠিকানায় আপু এসে হাজির হন।
তিনি এসে সব শুনেন, সেই বন্ধুর পরিচিত লোক ও তার পরিবারের সাথেও কথা বলেন। বুঝিয়ে বলেন। তারপর আমাকে নিয়ে যান তাঁর বাসায়।
এরপর জানতে পারি, আব্বু ইতোমধ্যে দেশে পৌঁছে গেছেন। আমাকে না পেয়ে, কোনো কিছু না ভেবে উনি দেশে ফিরে এসেছেন শুধুমাত্র আমাকে খুঁজে পেতে।
সেই দিনটা আমার ভিতরটাকে বদলে দিয়েছিল। আমি আব্বুকে ভয় পেতাম, এখনও পাই। উনি রাগী, মুখে কোনোদিন কোমল কথা শুনিনি। কিন্তু তখন বুঝেছিলাম—ভালোবাসা সবসময় শব্দ দিয়ে প্রকাশ পায় না।
আব্বু কোনোদিন বলেননি, “ভালোবাসি।” কিন্তু যেভাবে সব ছেড়ে ছুটে এসেছিলেন, সেই আগলে রাখার চেষ্টা—তাই তো নিঃশব্দ ভালোবাসার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
আজও আব্বুকে সব বলতে পারি না। কিন্তু প্রতিটা চুপ করে থাকা মুহূর্তের ভেতরেও তাঁকে ভালোবাসি। তিনি আমার জীবনের ছায়া, একজন নায়ক—নিঃশব্দ ভালোবাসার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট