ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পুনরুত্থান ও তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গত কয়েক মাসে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা ও গুলশানের মতো এলাকায় খুন, হামলা, চাঁদাবাজি, সম্পদ দখল ও আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম বারবার উঠে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, গত দুই মাসে তিনটি হত্যাকাণ্ডসহ অন্তত আটটি স্থানে বিভিন্ন অপরাধে এই সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতি রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের চ্যালেঞ্জকে স্পষ্ট করে।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কেবলমাত্র শারীরিক সহিংসতায় জড়িত নয়, বরং তাদের অপরাধের ধরন বৈচিত্র্যময়। কেবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ময়লা বাণিজ্য, কোরবানির পশুর হাট, এমনকি জমি ও সম্পদ দখলের মতো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক খাতগুলো তাদের প্রধান লক্ষ্য।
উদাহরণস্বরূপ, বাড্ডার গুদারাঘাটে বিএনপি নেতা কামরুল আহসানের হত্যা এবং হাতিরঝিলে যুবদল সদস্য আরিফ শিকদারের হত্যাকাণ্ড কেবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বের ফল। এছাড়া, মগবাজারে বিএনপি সদস্য মো. রাজনের উপর হামলা এবং গুলশানে সুমন মিয়ার হত্যা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও শক্তি প্রদর্শনের অংশ। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কিছু সন্ত্রাসী দল সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে, যা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশি ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে কিলার আব্বাস, পিচ্চি হেলাল, ক্যাপ্টেন ইমন, টিটন ও ফ্রিডম রাসুসহ অন্তত ছয়জন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্ত হন। এরা দীর্ঘদিন কারাভোগের পর মুক্ত হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়েছেন।
এছাড়া, জিসান আহমেদ, জাফর আহমেদ মানিক ও বিকাশ কুমার বিশ্বাসের মতো সন্ত্রাসীরা বিদেশে থেকেও স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, মেহেদী (যুক্তরাষ্ট্র) ও রবিন (মালয়েশিয়া) তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে গুলশান ও বাড্ডায় চাঁদাবাজি ও দখলের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এই আন্তর্জাতিক সংযোগ অপরাধ নিয়ন্ত্রণকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) জানিয়েছে, তারা এলাকাভিত্তিক নজরদারি ও সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসী তৎপরতা কমিয়েছে। সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শুটার মাহফুজুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে, অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুরু থেকেই কঠোর নজরদারি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। বর্তমানে সন্ত্রাসীদের সহযোগীদের চিহ্নিত করে তাদের উপর নজরদারি জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমে সাময়িক শিথিলতা এই সন্ত্রাসীদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। তাদের অপরাধের জাল এখন কেবল স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে।
অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে আরও বড় সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি করছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় অপরাধের এই জাল আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।