তিস্তার পানিবৃদ্ধি: ভারতে রেড অ্যালার্ট, বাংলাদেশে বন্যার শঙ্কা

New-Project-17.jpg

পাহাড়ি ঢল

২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ

কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে তিস্তা নদীতে পানির স্তর দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় শনিবার (৩১ মে, ২০২৫) ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর (আইএমডি) সিকিমে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। সিকিমের মাঙ্গান, গিয়ালশিং ও সোরেং জেলায় বন্যা এবং ভূমিধসের ঝুঁকির কারণে এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গ্যাংটক জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এক জরুরি গণবিজ্ঞপ্তিতে স্থানীয় জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, তবে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশাসন জানিয়েছে, মাঙ্গান জেলার তিস্তা নদীর অববাহিকা, বিশেষ করে ডিকচু থেকে সিংতাম পর্যন্ত অঞ্চল, বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিমগুলোকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে, এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ভারতের উজানে পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে বাংলাদেশেও তিস্তা নদীর পানির স্তর বাড়ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী তিন দিন তিস্তার পানি আরও বাড়তে পারে, যা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুর জেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যার ঝুঁকি তৈরি করেছে। তিস্তা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী, যা সিকিমের হিমালয়ের চিতামু হ্রদ থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে শুক্রবার (৩০ মে) দুপুর ১২টায় পানির স্তর রেকর্ড করা হয়েছে ৫১.১৫ মিটার, যা বিপদসীমার মাত্র এক মিটার নিচে। রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টেও পানির স্তর দ্রুত বাড়ছে, এবং আগামী কয়েকদিনে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি আগামী তিন দিন বাড়তে পারে, যা সতর্কসীমায় পৌঁছাতে পারে।

রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ১ জুন পর্যন্ত এই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগের আট জেলায় গড়ে ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর প্রভাবে রংপুরের গঙ্গাচড়া, পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলার কিছু এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। তিস্তার তীরবর্তী প্রায় ৯৫টি চর এলাকা পানিতে প্লাবিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, যেখানে বসবাসকারী হাজারো মানুষ এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।

আদিতমারী উপজেলার চর গোবর্ধন এলাকার বাসিন্দা ফজলার রহমান বলেন, “বন্যা এলে আমাদের কিছুই থাকে না। মাঠের ফসল, গবাদি পশু, ঘরবাড়ি—সব ভেসে যায়। এবারও সবাই পলিথিন দিয়ে জিনিসপত্র বাঁচানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পানি বাড়লে কিছুই করার থাকে না।” তিনি আরও জানান, স্থানীয়রা ইতোমধ্যে উঁচু স্থানে ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছেন।

বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, ধলাই, সোমেশ্বরী ও মনু নদীর পানিও আগামী দুই দিন বাড়তে পারে, যা বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। তিস্তার পানিবৃদ্ধির প্রভাবে রংপুর বিভাগের নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা এবং নদীভাঙন মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে, এবং ত্রাণ বিতরণের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জাম মজুত করা হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে, এবং জনগণকে মোবাইল অ্যাপ, টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে আগাম সতর্কতা দেওয়া হচ্ছে।

তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, ভারতের গজলডোবা বাঁধ ও অন্যান্য সেচ প্রকল্পের কারণে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কমে যাওয়া এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানির ঝুঁকি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জ। ২০১৪ সালে গজলডোবা বাঁধের গেট বন্ধ করায় বাংলাদেশে তিস্তার পানিপ্রবাহ শূন্যে নেমে এসেছিল, যা স্থানীয় জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থানীয়রা বন্যার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি কার্যকর চুক্তির প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি ব্যবস্থাপনা এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার করা গেলে বন্যার ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

Leave a Reply

scroll to top