বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস

শিশুশ্রমের ছায়ায় শৈশব

একটি শিশুশ্রমে নিযুক্ত ছেলেশিশু কারখানার ভেতরে কাজ করছে, মুখে ক্লান্তির ছাপ।

কারখানায় মেশিনের পাশে শিশুশ্রমে নিয়োজিত এক কিশোর — ছবি: ইউনিসেফ

মুহাম্মদ নূরে আলম

রাজধানীর একটি ব্যস্ত শিল্পাঞ্চলে সকালের শান্ত ভোর। কিন্তু ১২ বছরের রুবেলের জন্য এই ভোর কোনো নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে আসে না। তার দিন শুরু হয় একটি ছোট ওয়ার্কশপে, যেখানে সে সারাদিন ধাতব পাইপ কাটে, পলিশ করে, আর মেশিনের তৈলাক্ত গন্ধের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। তার হাতে কোনো বই নেই, চোখে নেই পড়াশোনার আলো। তার কাঁধে ঝুলছে পরিবারের দায়িত্ব, আর হাতে ধরা একটি ভারী হাতুড়ি।

আজ, ১২ জুন, বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে এই দিনটি পালন করে আসছে, যাতে বিশ্বের প্রতিটি কোণে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়, বরং একটি গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার দিন—কেন এখনো হাজার হাজার শিশু তাদের শৈশব হারিয়ে কারখানার ধোঁয়ায়, রাস্তার ধুলোয়, বা হোটেলের রান্নাঘরে কাজ করে যাচ্ছে?

ইউনিসেফ ও আইএলও’র সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন শিশু শ্রমে নিয়োজিত। বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় ১.৭ মিলিয়ন, যাদের অধিকাংশই ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী। এই শিশুরা কাজ করে ইটভাটায়, গার্মেন্টস কারখানায়, চায়ের দোকানে, এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে। তাদের মধ্যে অনেকেই দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে, আর বিনিময়ে পায় নগণ্য মজুরি।

ঢাকার একটি ইটভাটায় কাজ করা ১৪ বছরের সুমাইয়া জানায়, “আমার বাবা অসুস্থ। আমি আর আমার ভাই না কাজ করলে আমাদের খাবার জোটে না।” সুমাইয়ার গল্প একা নয়। দেশের প্রতিটি শিল্পাঞ্চল, গ্রাম, বা শহরের অলিগলিতে এমন অসংখ্য শিশুর গল্প ছড়িয়ে আছে।

শিশুশ্রমের পেছনে দারিদ্র্য একটি প্রধান কারণ হলেও, এটি একমাত্র কারণ নয়। শিক্ষার অপ্রতুলতা, অভিভাবকদের অসচেতনতা, এবং সামাজিক নিয়ম-কানুনের দুর্বল প্রয়োগ এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে হলেও, স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বই, ইউনিফর্ম, বা পরিবহন খরচ অনেক পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, অনেক শিশু পড়াশোনার পরিবর্তে কাজে যোগ দেয়।

শ্রম অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের আইন আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও সংস্থান নেই। অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা শিশুদের কম মজুরিতে কাজ করানোর সুযোগ নেন।” বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে, এই আইনের প্রয়োগ প্রায় নগণ্য।

শিশুশ্রম শুধু শৈশব কেড়ে নেয় না, এটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল হক বলেন,

“কারখানায় কাজ করা শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, পিঠের ব্যথা, এবং মানসিক চাপের সমস্যা দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ কাজ করার কারণে তাদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।”

এছাড়া, শিক্ষার অভাবে এই শিশুরা বড় হয়ে দক্ষ শ্রমিক বা পেশাজীবী হওয়ার সুযোগ হারায়। ফলে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে তারা বের হতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ফারুক আহমেদ বলেন, “শিশুশ্রম কেবল একটি শিশুর জীবন নষ্ট করে না, এটি গোটা সমাজের উন্নয়নকে পিছিয়ে দেয়। শিক্ষিত শিশুরাই একটি দেশের ভবিষ্যৎ।”

শিশুশ্রম নির্মূলে একক কোনো সমাধান নেই। এটি দূর করতে হলে সরকার, সমাজ, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সাশ্রয়ী ও অ্যাক্সেসযোগ্য করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য শিক্ষা ভর্তুকি, বিনামূল্যে বই, এবং মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পারে।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করলে শিশুদের কাজে পাঠানোর প্রয়োজন কমবে। তৃতীয়ত, শ্রম আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।

বেসরকারি সংস্থাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্র্যাক ও সেভ দ্য চিলড্রেনের মতো সংস্থাগুলো শিশুশ্রমিকদের পুনর্বাসন ও শিক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু সরকার বা সংস্থার দায়িত্ব নয়, এটি সমাজের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। একটি চায়ের দোকানে কাজ করা শিশুকে দেখলে আমরা কি তাকে স্কুলে ফেরানোর কথা ভাবি? নাকি তার পরিশ্রমকে ‘বাস্তবতা’ বলে মেনে নিই? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে এই শিশুদের জীবন বদলে দিতে।

ঢাকার একটি এনজিও’র প্রতিনিধি মাসুদা আক্তার বলেন, “আমরা যদি প্রত্যেকে একটি শিশুকেও শ্রম থেকে মুক্ত করে পড়াশোনার সুযোগ দিতে পারি, তাহলে সমাজ বদলাতে শুরু করবে।” তিনি আরও বলেন, সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা শিশুশ্রম কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

রুবেল বা সুমাইয়ার মতো শিশুদের জন্য একটি নতুন ভোর সম্ভব। তবে তা সম্ভব হবে তখনই, যখন আমরা সবাই মিলে তাদের হাতে হাতুড়ি বা ইটের পরিবর্তে বই তুলে দেব। তাদের চোখে ক্লান্তির পরিবর্তে স্বপ্ন ফোটাব। এই বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক—একটি শিশুও যেন তার শৈশব হারায় না, একটি শিশুও যেন কারখানার অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।

শিশুশ্রম নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই লড়াই চলবে। কারণ, প্রতিটি শিশুর হাতে কলমই হচ্ছে একটি জাতির ভবিষ্যৎ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

scroll to top