২০১০ সালে রংপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত এক সেবিকা ধর্ষণের শিকার হন। সেই বছরেরই আগস্টে তিনি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। বরং আইনি জটিলতা এবং বিচার বিলম্বে বেড়েছে হয়রানি ও ব্যয়। শুধু ওই সেবিকা নন, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এমন হাজারো মামলার দীর্ঘসূত্রতায় ভুগছেন অসংখ্য ভুক্তভোগী।
রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। এর মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলাই অন্তত দেড় হাজার। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, বিচার বিলম্বিত হওয়ার ফলে অভিযুক্তরা যেমন সুযোগ পায়, তেমনি ভুক্তভোগীরা বছরের পর বছর ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন।
মামলার দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ ওই সেবিকা বলেন, “১৫ বছর ধরে শুধু আদালতে যাই আর আসি। প্রতিবারই নতুন তারিখ শুনে ফিরে আসতে হয়। আইনজীবীকে নিয়মিত অর্থ দিতে হচ্ছে, অথচ বিচার এখনও দূরের পথ। পদে পদে শুধু হয়রানি আর খরচ।”
একই চিত্র আরেক ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রেও। সন্তানকে কোলে নিয়ে আদালতের বারান্দায় দাঁড়ানো এক নারী জানান, ২০১৩ সালে যৌন হয়রানির ঘটনায় মামলা করেন তাঁর পরিবার। আজও সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। তিনি বলেন, “বিয়ের প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল। কিন্তু মামলার কারণে পরিবারে অশান্তি লেগেই আছে। সামাজিকভাবে নানা চোখে দেখা হয়। মানসিক চাপও অনেক বেশি।”
এদিকে রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, ২ ও ৩—এই তিনটি আদালতেই মামলার স্তুপ জমে আছে। আদালত সূত্র জানায়, ট্রাইব্যুনাল-১-এ বর্তমানে ৩৬০০টি মামলা বিচারাধীন, যার মধ্যে ৭৯২টি ধর্ষণের মামলা। ট্রাইব্যুনাল-২-এ ১৬২০টি মামলার মধ্যে ৪০০টি এবং ট্রাইব্যুনাল-৩-এ ১২১৮টি মামলার মধ্যে ধর্ষণের মামলা রয়েছে ৩৫০টি। সবমিলিয়ে মোট ৬৪৩৮টি মামলার মধ্যে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা ১৫৪২টি।
মামলার বিলম্বের কারণে আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর গলে মুক্তি পেতে পারেন বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন আইনজীবীরা। রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী মো. আব্দুর রশীদ চৌধুরী বলেন, “মামলাগুলো যদি নির্ধারিত অধিবেশনে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে তারিখের পর তারিখ পেরিয়ে দুই-তিন বছর চলে যায়। আবার কোনো এক তারিখে মামলার রায় না হলে পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করতে হয়। এভাবে মামলা চলতে থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা বলা হলেও বাস্তবে তা মানা হয় না। নিয়ম অনুসারে দ্রুত নিষ্পত্তি হলে ভুক্তভোগীরা বিচার পেতেন।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, “১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি আদেশ হিসেবে আছে, আইন হিসেবে নয়। ফলে এটি বাধ্যতামূলক নয়। এটি যদি আইনে অন্তর্ভুক্ত করে বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে বিচার প্রক্রিয়া গতি পাবে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার যদি তদন্ত ১৫ দিনের মধ্যে এবং বিচার ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে, তবে মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমবে। এতে ভুক্তভোগীরাও দ্রুত বিচার পাবেন, যা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।”
তবে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শুধু মানসিক নয়, আর্থিকভাবেও ভুক্তভোগীদের দুর্দশায় ফেলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, “২৪ বছর ধরে কোর্টে যাই। একবার বলে আজ হবে, আবার বলে কাল হবে। আবার লম্বা তারিখ দেয়। এভাবে বছর পার হয়ে যাচ্ছে। কোনো সুফল নেই।”
আরেকজন বলেন, “আমার মামলায় বাদী ২০১৬ সালে মারা গেছেন। সাক্ষীও আসে না। অথচ আমি এখনও মামলায় ঝুলে আছি। আমি যদি অপরাধ করে থাকি, তাহলে শাস্তি দিন। কিন্তু সেটাও দেওয়া হচ্ছে না। দিন দিন শুধু অশান্তি বাড়ছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনি সংস্কার ছাড়া এই দীর্ঘসূত্রতা কমানো সম্ভব নয়। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে হবে আইন সংস্কার এবং পর্যাপ্ত বিচারক ও আদালতের মাধ্যমে। নয়তো প্রতিনিয়ত বাড়তেই থাকবে মামলাজট, আর হারিয়ে যাবে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা।