ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ

পরিকল্পিত না গভীর রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিং?

ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে, রাজনৈতিক আলোচনা ও গণতন্ত্র সংস্কার নিয়ে আলোচনার দৃশ্য।
২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ এম আলী

নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ (আপ বাংলাদেশ)-এর আত্মপ্রকাশ ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। দলটি আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে ৯ মে। অথচ মাত্র ৫ দিনের মাথায়, ১৪ মে, তারা বৈঠকে বসে জাতিসংঘের তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। এমন দ্রুতগতির আন্তর্জাতিক সংযোগ কতটা স্বাভাবিক—তা নিয়েই এখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ইউপি বাংলাদেশ।

বৈঠকের বিষয়বস্তু ও বিস্ময়

জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে ইউপি বাংলাদেশের নেতারা বিচারব্যবস্থার সংস্কার, গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে আলোচনা থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই প্রশ্নটি—মাত্র ১২০ ঘণ্টার ব্যবধানে এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক কীভাবে সম্ভব হলো?

বৈঠকের পেছনে যে ৪টি সম্ভাবনা আলোচিত হচ্ছে:

১. পূর্বপ্রস্তুতির আভাস
‘আপ বাংলাদেশ’ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ৯ মে। কিন্তু বাস্তবে দলটি হয়তো এর আগেই—আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বহু আগে—গোপনে সংগঠন, নীতি ও আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপন কাজ চালিয়ে আসছিল। এর মানে দলটি ‘পাবলিকলি’ ৫ দিন পুরোনো হলেও ‘কার্যত’ কয়েক মাসের প্রস্তুতির ফসল। এই সময়ের মধ্যেই তারা জাতিসংঘ বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে বৈঠকের সময় নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।

২. প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকতা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এত দ্রুত আন্তর্জাতিক মহলে প্রবেশাধিকার পাওয়ার পেছনে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে পারে। এটি হয়তো কোনো পক্ষের কৌশলগত ‘নিরাপদ বিরোধী শক্তি’ তৈরি করার অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

৩. জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের ম্যান্ডেট প্রশ্নবিদ্ধ
জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল সাধারণত স্বীকৃত, স্থায়ী এবং কার্যকর রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে বৈঠক করে। ইউপি বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৫ দিন—তাদের সঙ্গে দেখা করাটা কতটা যুক্তিসংগত তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

৪. নির্বাচন সামনে রেখে কৌশলগত বার্তা
নতুন এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে একটি বার্তা দেওয়া হচ্ছে: “দেশে দুই প্রধান দল ছাড়াও উদীয়মান গণতান্ত্রিক শক্তি রয়েছে।” এটি নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ‘বহুমাত্রিক বিরোধী রাজনীতি’ প্রদর্শনের কৌশল হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

নির্বাচনের আগে ‘নতুন কার্ড’?

রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, ২০২৫-এর শেষভাগ বা ২০২৬ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন। এরই মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ, সংলাপের ব্যর্থতা ও বিদেশি উদ্বেগ প্রকট হয়ে উঠেছে। ঠিক এই সময়েই ইউপি বাংলাদেশের আবির্ভাব এবং জাতিসংঘের বৈঠকে অংশগ্রহণ অনেককেই মনে করিয়ে দিচ্ছে আগের নির্বাচনের সময় ‘নিরাপদ বিরোধী প্ল্যাটফর্ম’ তৈরির অভিজ্ঞতা।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও সন্দেহ

বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, এই নতুন প্ল্যাটফর্মের উত্থান এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কোনো বিশেষ ‘প্রক্সি রাজনৈতিক খেলা’র ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিএনপির একাধিক নেতার মতে, “রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একটি সদ্য গঠিত দল এভাবে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারে না।”

অনেকে এটিকে সম্ভাব্য নির্বাচন বানচাল বা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অংশ হিসেবে দেখছেন, যেখানে বাস্তব রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে—যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে ‘নতুন গণতান্ত্রিক শক্তি’র ছবি তুলে ধরা যাবে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের মতে, সাধারণত জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দীর্ঘদিনের কার্যক্রম, তৃণমূল সংগঠন, অভ্যন্তরীণ নীতি এবং জনসম্পৃক্ততা যাচাই করে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসে। এখানে পাঁচ দিনের মধ্যে এমন একটি বৈঠক ‘অস্বাভাবিক’ বলেই মনে করছেন অনেকেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল কারা, তাদের ম্যান্ডেট কী, এবং তারা কার পরামর্শে এই নবগঠিত দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। রাজনৈতিকভাবে এটি একটি বার্তা—যেটি হয়ত দেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু ঘটার পূর্বাভাসও হতে পারে।”

এই বৈঠক কী বার্তা দেয়?

  • আন্তর্জাতিকীকরণ প্রচেষ্টা: পাঁচ দিনের মাথায় জাতিসংঘে বৈঠক হওয়ার অর্থ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বার্তা পৌঁছানো—নতুন দলটি গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী হতে চায়।
  • মূলধারার রাজনীতিতে আস্থাহীনতা: এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, হয়তো দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর আস্থা কমছে, এবং বিকল্প তৈরি হচ্ছে।
  • নির্বাচনী কাঠামোয় নতুন ভূমিকা খোঁজা: ইউপি বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনকালীন সরকার বা জাতীয় সংলাপে ‘নিরপেক্ষ শক্তি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা থাকতে পারে।

“আপ বাংলাদেশ” এর আত্মপ্রকাশ এবং দ্রুততম সময়ে জাতিসংঘ সংযোগ—এটি নিছক একটি কাকতাল নাকি গভীর রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ? উত্তর এখনও অস্পষ্ট। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি যে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Leave a Reply

scroll to top