আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলদের অভিন্ন দাওয়াত কী ছিল?

নবী-রাসূলদের অভিন্ন দাওয়াত

প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক ধর্ম ডেস্ক

আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানব জাতির সঠিক পথের দিশারী হিসেবে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের প্রত্যেকের দাওয়াত বা আহ্বান ছিল এক ও অভিন্ন—এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং শিরক ও তাগুত থেকে দূরে থাকা। হজরত আদম (আ.), নূহ (আ.), মূসা (আ.), ঈসা (আ.) ও শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—সবাই মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদের পথে আহ্বান করেছেন।

নবীদের প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে হেদায়াতের পথে ফেরানো, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য শেখানো এবং ইহকাল ও পরকালের সফলতার দিক নির্দেশনা দেওয়া। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কোনো নবীকে এমন দায়িত্ব দেননি যে তিনি নিজেকে উপাস্য রূপে উপস্থাপন করবেন। বরং, তারা সবাই ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও প্রেরিত রাসূল।

নবীদের দাওয়াত: তাওহীদের দিকে আহ্বান

পবিত্র কোরআনের ভাষায়,

وَ مَا نُرۡسِلُ الۡمُرۡسَلِیۡنَ اِلَّا مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ ۚ فَمَنۡ اٰمَنَ وَ اَصۡلَحَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿۴۸﴾و ما نرسل المرسلین الا مبشرین و منذرین ۚ فمن امن و اصلح فلا خوف علیهم و لا هم یحزنون 

“আর আমি রাসূলদেরকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করি। অতএব যারা ঈমান এনেছে ও শুধরে নিয়েছে, তাদের উপর কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না।”
(সূরা আনআম, আয়াত : ৪৮)

একইভাবে আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন,

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ ﴿۲۵﴾و ما ارسلنا من قبلک من رسول الا نوحی الیه انهٗ لا اله الا انا فاعبدون

“আর তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল আমি পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদত কর।’”
(সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ২৫)

এসব আয়াত প্রমাণ করে, সকল নবী-রাসূলের দাওয়াত ছিল এক, এবং তা হলো: আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সমস্ত মিথ্যা উপাসনার পথ থেকে সরে আসা।

 

নবী-রাসূলদের ভূমিকায় মানবিক ও সমাজিক আদর্শ

নবীদের দাওয়াত শুধু ধর্মীয় আচারে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তারা মানুষকে সামাজিক সৌহার্দ্য, ন্যায়বিচার, দয়া ও নম্রতায় জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। তারা শেখিয়েছেন, যে আচরণ মানুষকে অকল্যাণে ঠেলে দেয় কিংবা আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তা পরিত্যাজ্য।

তাদের জীবন ছিল বাস্তব ও অনুসরণযোগ্য উদাহরণ। একদিকে তারা যেমন আল্লাহর পথে আমরণ সংগ্রাম করেছেন, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন একজন আদর্শ বাবা, স্বামী, নেতা ও সমাজসংগঠক।

শরিয়তের ভিন্নতা, দাওয়াতের অভিন্নতা

যদিও সময় ও সমাজ ভেদে নবীদের শরিয়ত বা বিধানাবলী ছিল ভিন্ন, তবে মূল দাওয়াত কখনোই বদলায়নি। প্রত্যেকে তাদের উম্মতকে আল্লাহর পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের মধ্য দিয়েই নবুয়তের শিকল সম্পূর্ণ হয় এবং তাঁর দাওয়াত পূর্ণতা লাভ করে।

 

চারটি অভিন্ন সুন্নত: নবীদের জীবনচর্চা

নবী-রাসূলদের জীবনে কিছু বিষয় এমন ছিল, যা সব নবীর মধ্যেই পাওয়া যায়। এই চারটি অভিন্ন সুন্নত আমাদের জন্য দিকনির্দেশক ও অনুকরণীয়। হাদিসে এসেছে—

“চারটি জিনিস নবীদের চিরাচরিত সুন্নত। ১. লজ্জা-শরম, ২. সুগন্ধি ব্যবহার, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. বিয়ে করা।”
(জামে আত-তিরমিজি, হাদিস : ১০৮০)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবীদের ব্যক্তিগত আচরণেও ছিল পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্যবোধ ও মানবিকতা। এটি প্রমাণ করে, ইসলাম কেবল আত্মিক বা আধ্যাত্মিক উন্নয়নের ধর্ম নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনকে শুদ্ধ ও শালীন করার শিক্ষাও দেয়।

 

নবী হত্যার ইতিহাস: বনি ইসরাঈলের বেপরোয়া আচরণ

কোরআন বর্ণনা করে, বনি ইসরাঈল জাতি তাদের কাছে আগত নবীদের অমান্য করেছিল, এমনকি কিছু নবীকে তারা হত্যা করতেও পিছপা হয়নি। এটি আল্লাহর বড় গজবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এমন ঘটনায় ইসলামের দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট—আল্লাহর প্রেরিত বান্দাদের অস্বীকার ও অবমাননা মানে মূলত আল্লাহকেই অস্বীকার করা।

 

অনুসরণের একমাত্র পথ—নবীদের আদর্শ

মানুষের জীবনচক্রে বিভ্রান্তি, অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে সত্যিকারের পথনির্দেশনা একমাত্র আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসূলদের মধ্যেই নিহিত। তাদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যেমন ইহকালে শান্তি লাভ করতে পারি, তেমনি পরকালেও মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়।

আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবাইকে নবীদের পথে চলার তাওফিক দান করেন এবং তাওহীদের পথে অটল থাকার শক্তি দেন—এই দোয়ায় শেষ করছি।

Leave a Reply

scroll to top