“যদি কেউ বলে সে মৃত্যুকে ভয় পায় না, তবে হয় সে মিথ্যা বলছে, নয় সে একজন গোর্খা সেনা।” ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশের এই বিখ্যাত উক্তিটি গোর্খা সেনাদের বীরত্বের সবচেয়ে নিখুঁত উপমা।
‘গোর্খা’ শব্দটি এসেছে নেপালের ‘গোর্খা জেলা’ থেকে, যেখানে প্রাচীনকাল থেকেই যোদ্ধা সম্প্রদায়ের বসবাস। সেই গোর্খারা আজ শুধু পাহাড়েই নয়, ভারতের সেনাবাহিনীর বুকেও অটুট সাহসের প্রতীক। গোর্খা রেজিমেন্টের সাহসিকতা ও লড়াইয়ের কাহিনি শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক সামরিক ইতিহাসেও রূপকথার মতো উচ্চারিত হয়। ১৮১৫ সালের আংলো-নেপাল যুদ্ধেই গোর্খাদের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হয় ব্রিটিশরা। কিন্তু যুদ্ধ শেষে গোর্খাদের অসাধারণ সাহস, যুদ্ধশৈলী এবং শৃঙ্খলাবোধে এতটাই মুগ্ধ হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে, ‘নাসিরি ব্যাটালিয়ন’ নাম দিয়ে প্রথম গোর্খা সেনা ইউনিট গঠন করে।
এরপর থেকেই ব্রিটিশদের রেজিমেন্টে গোর্খারা ছিল অভ্যন্তরীণ শক্তি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে তারা লড়েছিল ব্রিটিশদের পক্ষে — ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনালগ্নে তারা “শত্রু” হিসেবেই বিবেচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই দুই লক্ষ নেপালি গোর্খা সৈন্য ব্রিটিশ পক্ষে অংশ নেয়, যার মধ্যে প্রায় ২০ হাজার প্রাণ হারান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও গোর্খা রেজিমেন্ট হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সাহসিকতা ছিল কিংবদন্তির মতো। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে গোর্খা রেজিমেন্টের ১০টি ইউনিটের মধ্যে ৭টি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে থেকে যায়, বাকিগুলো যুক্তরাজ্যে। আজকের দিনে এই ৭টি রেজিমেন্টে রয়েছে ৪৬টি ব্যাটালিয়ন এবং ৪২ হাজারেরও বেশি গোর্খা সেনা।
প্রতিটি গোর্খা সেনার সঙ্গে থাকে এক জোড়া কুখ্যাত “কুকরি” — ১৮ ইঞ্চির বাঁকানো ধারালো ছুরি। এটি শুধু অস্ত্র নয়, বরং সাহস, সম্মান আর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এটি এতটাই সম্মানজনক যে, আজও উৎসব কিংবা অনুশীলনের সময় এক কোপে মহিষ বলি দেওয়ার প্রথা চলে আসছে। দশরার দিনে সবচেয়ে নবীন সৈনিককে দেওয়া হয় এই বলি দেওয়ার সুযোগ—এই ঐতিহ্য গোর্খা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গোর্খা রেজিমেন্টের বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া হয়েছে:
- ৩টি পরমবীর চক্র
- ৩৩টি মহাবীর চক্র
- ৮৪টি বীর চক্র
এই রেকর্ড অনেক রেজিমেন্টের পক্ষেই ছোঁয়া অসম্ভব। গোর্খারা শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নন। তারা ব্রিটিশ ও সিঙ্গাপুর সেনাবাহিনীতেও কাজ করছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সামরিক জগতেও গোর্খারা এক অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। বছরপ্রতি প্রায় ১২০০ থেকে ১৩০০ নেপালি গোর্খা ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এদের উচ্চতা হয় সাধারণত ৫ ফুট ২ থেকে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি — ছোটখাটো গড়নের হলেও শক্তিতে, সাহসে বা সহনশীলতায় কারো চেয়ে কম নয়। গোর্খারা বহু বছর ধরে “ভাড়াটে সেনা” হিসেবে পরিচিত, যা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। সমালোচকরা বলেন, একটি স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে কেন অন্য দেশের নাগরিক অংশ নেবে? আবার অন্যপক্ষ বলে, এই পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে উভয় দেশই লাভবান।
একটি প্রজন্ম বিশ্বাস করে—সাহসের কোনো দেশ হয় না, সাহসই দেশকে শক্ত করে। গোর্খা রেজিমেন্ট একটি নাম নয়, এটি একটি বীরত্বের চেতনা। ইতিহাসের পাতায়, যুদ্ধের মাঠে কিংবা প্রজন্মের গল্পে গোর্খারা রয়েছেন এক সাহসিক আদর্শ হয়ে। তারা শুধু চাকু হাতে সেনা নয়, তারা এক জীবন্ত প্রমাণ—ভয় পেলে যুদ্ধ হয় না, সাহস পেলেই ইতিহাস লেখা যায়।