এনবিআর ভেঙে দুই বিভাগ: রাজস্ব প্রশাসনে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, উঠছে প্রশ্নও

New-Project-32-4.jpg

এনবিআর

২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে গঠন করা হয়েছে দুটি পৃথক বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। সোমবার (১৩ মে) দিনগত রাতে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বহুল আলোচিত এ পুনর্গঠন কার্যকর করা হয়।

এ সিদ্ধান্তকে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় “যুগান্তকারী পরিবর্তন” হিসেবে দেখা হলেও, এর পেছনে থাকা প্রক্রিয়া, স্টেকহোল্ডারদের অসন্তোষ এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা ঘিরে নতুন বিতর্কের জন্ম নিয়েছে।

কী রয়েছে নতুন কাঠামোয়

নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এনবিআরের বিদ্যমান কাঠামো বিলুপ্ত করে দুটি আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়েছে:

  • রাজস্ব নীতি বিভাগ: কর কাঠামো উন্নয়ন, আইন সংস্কার, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক কর বিষয় দেখভাল করবে।
  • রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ: কর আদায়, আইন প্রয়োগ ও মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করবে।

দুই বিভাগই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে এবং পৃথক সচিবের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে।

রাজস্ব নীতি বিভাগের অধীন থাকবে কর ও কাস্টমস আপিল ট্রাইব্যুনাল। এটি কর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেছে সরকার।

প্রতিশ্রুতি: স্বচ্ছতা ও দক্ষতা

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতি ও বাস্তবায়ন কাঠামো পৃথক হওয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা বাড়বে। বাজেট পরিকল্পনা ও রাজস্ব সংগ্রহ হবে আরও গতিশীল।

বিশ্লেষকরাও বলছেন, উন্নত অনেক দেশেই নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক থাকে, ফলে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে দুই পক্ষই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশও একই পথে এগোলো।

ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরোধিতা ও বিক্ষোভ

অধ্যাদেশ জারির পরপরই দেশের কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অভিযোগ, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় স্টেকহোল্ডারদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে এবং মূল কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই এনবিআর বিলুপ্ত করা হয়েছে।

সোমবার সকালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত রাজস্ব ভবনে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের প্রায় ৫০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিক্ষোভ করেন। এর ফলে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।

তাদের দাবি, এই সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ক্যাডারদের পদোন্নতির সুযোগ সংকুচিত হয়েছে এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চলে যাচ্ছে অভিজ্ঞতাবিহীন অ্যাডমিন ক্যাডারের হাতে, যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করতে পারে।

বিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা

মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা রাজস্ব ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। আয়োজকরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিও নেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

রাজস্ব প্রশাসনের পুনর্গঠনকে কেউ দেখছেন দীর্ঘদিনের কাঠামোগত সমস্যার সমাধান হিসেবে, কেউ আবার বলছেন এটি একপেশেভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যা ভবিষ্যতে রাজস্ব ঘাটতি ও প্রশাসনিক জটিলতা বাড়াতে পারে।

তাদের মতে, নীতি বিভাগ ও বাস্তবায়ন বিভাগ আলাদা করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হলেও, সেটি দক্ষ নেতৃত্ব, সমন্বয় ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সফল হবে না।

সংবিধান অনুযায়ী অধ্যাদেশ জারি

রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে এই অধ্যাদেশ জারি করেন। এর আওতায় বিলুপ্ত করা হয়েছে এনবিআরের অধীন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (IRD)। এ বিভাগের জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে যুক্ত হবে।

নতুন অধ্যাদেশে উচ্চপর্যায়ের পরামর্শক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে থাকবে অর্থনীতিবিদ, কর বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিনিধি।

ফলাফল নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর

পর্যবেক্ষকদের মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব সংস্থাকে ভেঙে দুটি বিভাগ গঠনের ফলে প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ কমবে এবং দক্ষ জনবলের সক্রিয়তা বাড়বে—এই লক্ষ্যে সিদ্ধান্তটি নেয়া হলেও বাস্তবায়নে ভুল হলে প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভয়াবহ।

সরকারের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের আস্থা পুনর্গঠন, দক্ষ নেতৃত্ব নিশ্চিত করা, এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কার্যকর রাজস্ব কাঠামো তৈরি করা।

Leave a Reply

scroll to top