আওয়ামী লীগের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধকরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা; শহীদ পরিবার ও সব আন্দোলনরত শক্তিকে এক হওয়ার আহ্বান

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে ফের রাজপথে নাহিদ ইসলামের ঘোষণা

IMG-20250508-WA0006.jpg
মুহাম্মাদ নূরে আলম

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে রাজপথ। জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠক নাহিদ ইসলাম আবারও আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে এক উন্মুক্ত বিবৃতিতে তিনি ঘোষণা করেন, “আজ রাতেই ফয়সালা হবে আওয়ামী লীগের বিষয়ে।”

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন নাহিদ ইসলাম। তার ভাষ্য অনুযায়ী, “আমরা দেখতে পাচ্ছি ফ্যাসিস্ট ও খুনী আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে টালবাহানা চলছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত আসছে না।”

তিনি দাবি করেন, সরকারের পক্ষ থেকে খুনিদের জামিন দেওয়া হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ আসামিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়েছে। “এই বাস্তবতা আমাদের মনে সরকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে,”— বলেন তিনি।

নাহিদ ইসলাম এমন এক সময় এই ঘোষণা দিলেন, যখন দেশজুড়ে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জুলাই ও আগস্ট মাসে যে গণআন্দোলন হয়েছিল, সেটি মূলত ছিল ‘মুজিববাদী দমন’ ও ‘আওয়ামী লীগের বিচার’ ঘিরে সংগঠিত। সে সময় অনেক শহীদ, আহত এবং নিখোঁজের ঘটনা সামনে আসে, যা জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

নাহিদ ইসলাম তখন থেকেই এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ, গণঅবস্থান ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অনেকেই তাকে ‘গণআন্দোলনের তরুণ মহানায়ক’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন।

নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগের বিচারকে ‘দুই মিনিটের কাজ’ হিসেবে না দেখে দীর্ঘ, সংগ্রামী ও কঠিন বাস্তবতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, এই বিচার পেতে হলে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যই নয়, সংগঠিত শক্তি, জনসমর্থন এবং বিকল্প চিন্তার রাজনীতিও প্রয়োজন।

তিনি বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম— খুনীদের বিচার হবে। এবং মুজিববাদীরা বাংলার মাটিতে আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? জামিন দেওয়া হচ্ছে, মামলা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে, আর জনগণের সঙ্গে উপহাস করা হচ্ছে।”

নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধকরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ থেকে উঠবেন না। “কেবল মৌখিক বিবৃতি বা প্রতিশ্রুতি নয়, আমরা লিখিত ও সময়সীমাসম্পন্ন রোডম্যাপ চাই,”— তিনি বলেন।

এই রোডম্যাপে কী থাকতে হবে, তা নিয়েও কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছেন তিনি:

  • একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন গঠন
  • দলটির রাজনৈতিক লাইসেন্স বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার সূচনা
  • ১৯৭৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দলটির নেতৃত্বে সংঘটিত সহিংসতার নথিপত্র প্রকাশ
  • বিচার বিভাগীয় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ

নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “যারা এই দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের স্বজনদের চোখের জল এখনো শুকায়নি। আমি তাদের বলছি— এই লড়াই আপনাদের সম্মানের জন্য, আপনাদের বিচারের জন্য।”

তিনিই প্রথমবারের মতো ‘শহীদ পরিবার একতা ফোরাম’ গঠনের প্রস্তাব দেন এবং আশা প্রকাশ করেন, এই ফোরাম হবে বিচার আন্দোলনের একটি নৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ হানিফ বলেন, “নাহিদ ইসলামের মতো তরুণ নেতারা নতুন ধারার রাজনীতির চর্চা শুরু করেছেন। তারা শুধু বিরোধিতা করছেন না, বরং বিকল্প ভাবনাও উপস্থাপন করছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য আশাব্যঞ্জক।”

তবে তিনি এটাও মনে করেন যে, “বিচার, নিষিদ্ধকরণ ও নিবন্ধন বাতিল— এই তিনটি বিষয় বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে। এগুলো আদায় করতে হলে আরও বিস্তৃত কৌশল ও সাংগঠনিক পরিপক্বতা প্রয়োজন।”

নাহিদ ইসলামের এই ঘোষণার পরপরই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় তার সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে। সামাজিক মাধ্যমে তাকে সমর্থন জানিয়ে হাজার হাজার পোস্ট হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে এখনো কোনো মন্তব্য আসেনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি সরকার নাহিদ ইসলামের দাবি ও অবস্থানকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে রাজপথে সংঘর্ষের আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে।

নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে বিচার ও জবাবদিহির দাবিতে নতুন করে রাজপথে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করেছে। এবার আন্দোলনের মুখ্য বিষয় কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরানো নয়, বরং ‘বিচার প্রতিষ্ঠা ও রাজনীতির নৈতিক পরিশুদ্ধতা’।

এই আন্দোলনের পরিণতি কী হবে— তা এখনই বলা না গেলেও, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ডাক ও দাবি বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে।

Leave a Reply

scroll to top