বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এক গভীর মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষার চাপ, চাকরির অনিশ্চয়তা, পরিবারিক প্রত্যাশা, সামাজিক প্রতিযোগিতা, সম্পর্কের জটিলতা, ডিজিটাল নিঃসঙ্গতা—সব মিলিয়ে তরুণরা যেন দিশেহারা। তাদের অনেকেই নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে না, ফলে নিঃশব্দে হারিয়ে যায় হতাশার গহ্বরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যতটা না কথা হয়, বাস্তবে ততটাই অবহেলা করা হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তরুণরা কাউন্সেলিং নিতে লজ্জা পায় বা ভয় পায়। অথচ প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজপড়ুয়া শত শত তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করে, কিংবা অবসাদে ভোগে।
ডিজিটাল দুনিয়ায় নিঃসঙ্গতা
তরুণ প্রজন্ম এখন প্রায় পুরোটা সময় কাটায় স্মার্টফোনে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক—এগুলোর মাধ্যমে তারা যুক্ত হয় বিশ্বে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয় নিজ পরিবার ও সমাজ থেকে। অন্যের আনন্দ, সাফল্য, সৌন্দর্য দেখে তারা নিজেদের অপ্রতুল ও ব্যর্থ ভাবতে থাকে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়া ‘সিন্ড্রোম’ তরুণদের মধ্যে হীনমন্যতা, অস্থিরতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি করছে।
পরিবারের অমনোযোগ
বর্তমানে অনেক বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান না। কর্মব্যস্ততা, সামাজিক মানসিকতা, পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব ইত্যাদি কারণে সন্তান তার সমস্যার কথা বলতে পারে না। কেউ কেউ একেবারেই একা পড়ে যায়।
তরুণী আফরিন (ছদ্মনাম) বলেন, “আমার মা-বাবা আমার পরীক্ষার ফল নিয়ে সবসময় অসন্তুষ্ট থাকতেন। আমি খুব চেষ্টা করতাম, কিন্তু তারা বলতেন ‘তোমার বন্ধুরা পারে, তুমি কেন পারো না?’ ধীরে ধীরে আমি নিজেকে দোষী ভাবতাম, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।”
এই ধরনের মনোভাব একজন তরুণকে সহজেই বিষণ্ন করে তুলতে পারে।
প্রতিযোগিতার চাপ
বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া, চাকরি পাওয়া, ‘সফল’ হওয়া—এই শব্দগুলো আজকের তরুণদের উপর অসহনীয় চাপ তৈরি করছে। পরিবার, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন সবাই চায়, তারা যেন অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের সক্ষমতা আলাদা। সেটা বুঝে নেওয়ার সুযোগ আমাদের সমাজে খুবই কম।
ফলাফল—হতাশা, আত্মগ্লানি, একাকীত্ব এবং শেষমেশ আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়
বেশিরভাগ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো কার্যকর সাপোর্ট সিস্টেম নেই। হেল্পলাইন, কাউন্সেলিং সেন্টার থাকলেও তা ব্যবহার হয় না বা অপর্যাপ্ত। শিক্ষক ও প্রশাসনও এই বিষয়ে সচেতন নন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই, কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, অর্থ ও জনবল নেই।”
সমাধান কী?
এই সংকট থেকে উত্তরণে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার।
- স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু করা
- পরিবারে ‘সহানুভূতির’ চর্চা বাড়ানো
- বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে কার্যকর কাউন্সেলিং সেবা
- সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সচেতনতা তৈরি
- সাহিত্য, খেলাধুলা, সৃজনশীল কাজে তরুণদের যুক্ত করা
সবচেয়ে বড় কথা, তরুণদের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। তারা যেন বলতে পারে, ‘আমি ভালো নেই’, এবং সেই কথা শোনার মতো মানুষ যেন সমাজে থাকে। তাহলেই গড়ে উঠবে এক আশাবাদী প্রজন্ম, যারা কেবল বাঁচবে না—জিতবেও।