বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। এর অন্যতম অনুঘটক যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ। শুরুতে যুদ্ধ ছিল শুল্ক আরোপ ও পাল্টা শুল্কে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে আরও সূক্ষ্ম এক ক্ষেত্রে—বিলাসবহুল পণ্যের বাজারে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্ট থেকে এই নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত মেলে।
সেই পোস্টে দাবি করা হয়েছে, চীনে নির্মিত Hermes ব্র্যান্ডের একটি Birkin ব্যাগ তৈরি করতে খরচ হয় মাত্র ১৮০ ডলার। অথচ সেই ব্যাগই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হয় প্রায় ২৫ হাজার ডলারে। শুধু তাই নয়, Dior-এর ৪০ ডলার মূল্যের হিল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ ডলারে এবং Gucci-এর ২০ থেকে ২৫ ডলারে প্রস্তুত হওয়া বেল্ট ও শার্ট বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৭০০ ও ৪০০ ডলারে। অর্থাৎ পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন খরচ এবং বাজারমূল্যের মধ্যে রয়েছে বিপুল ফারাক।
চীন দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বে OEM হিসেবে কাজ করে এলেও এখন তারা নিজেদের উৎপাদনক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে একই কাঁচামাল ও কারিগরিতে নামী ব্র্যান্ডের মতো দেখতে পণ্য তৈরি করছে এবং তা অনলাইনে বিক্রি করছে সাশ্রয়ী দামে। এতে বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের প্রতি ভোক্তাদের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
‘লাক্সারি মান নয়, মনস্তত্ত্ব’: চীনের কৌশলের ভিত্তি
চীনের এই কৌশল দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন বাস্তবতার ওপর—‘Luxury is not quality, it’s branding manipulation’। চীনা নির্মাতারা দেখাতে চাইছে, একটি ব্যাগ বা জুতার আসল দাম নয়, তা কেবল ক্রেতার মনের ভেতর গড়া এক অনুভূতি। এই অনুভূতিকে চ্যালেঞ্জ করেই বাজারে প্রবেশ করেছে চীনা ব্র্যান্ড ও প্যারালাল ব্র্যান্ডগুলো।

চীনা নির্মাতারা ব্র্যান্ডের গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন। ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব
এই প্রবণতা বিশ্বজুড়ে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের জন্য এক নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা এখন একই গুণগত মানের পণ্য তুলনামূলক কম দামে কিনতে পারছে। ফলে বিশ্বব্যাপী বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি ও প্রভাব কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চীনের নির্মাতারা এখন একই কাঁচামাল, একই কারিগরি এবং একই ফিনিশিং ব্যবহার করে নামী ব্র্যান্ডের মতো দেখতে পণ্য তৈরি করছে। এরপর সেগুলো অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করা হচ্ছে অত্যন্ত সাশ্রয়ী দামে। এতে করে ক্রেতাদের মনে প্রশ্ন জাগছে—আসলেই কী এই ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের মূল্য এতটা হওয়া উচিত?
বাজারে প্রভাব চীনের এই কৌশল বিশ্ববাজারে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রথমত, এটি বড় বড় বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ ক্রেতারা এখন সচেতন হচ্ছে যে তারা যেসব পণ্যে হাজার হাজার ডলার ব্যয় করছে, সেগুলোর প্রকৃত উৎপাদন খরচ তার ছিটেফোঁটাও নয়। দ্বিতীয়ত, এটি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিকল্প বাজারের সন্ধান দিচ্ছে, যেখানে তারা একই মানের পণ্য কম দামে পেতে পারে।
তৃতীয়ত, এই প্রবণতা বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কারণ যদি ভোক্তাদের মধ্যে ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়, তাহলে সেই ব্র্যান্ডগুলোর দাম নির্ধারণের ক্ষমতা খর্ব হবে।
মানসিক যুদ্ধ চীনের এই উদ্যোগ কেবল একটি ব্যবসায়িক কৌশল নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও বটে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাসমাজ দীর্ঘদিন ধরেই ব্র্যান্ড-নির্ভর। তারা একটি নির্দিষ্ট লোগো বা নামের জন্যই হাজার হাজার ডলার ব্যয় করতে অভ্যস্ত। চীন সেই মনস্তাত্ত্বিক পারসেপশনকেই চ্যালেঞ্জ করছে। তারা দেখাচ্ছে যে আসলে এই পণ্যগুলোর পেছনে যেটি বেশি দামী, তা হচ্ছে ক্রেতার মানসিক চাহিদা ও ব্র্যান্ড-ভিত্তিক পরিচিতি।
এই যুদ্ধ এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন বিশ্বজুড়ে ভোক্তারা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দাম বাড়ছে, মজুরি বাড়ছে না—এই পরিস্থিতিতে চীনের সস্তা কিন্তু একই মানের বিকল্প বাজারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
Temu, Shein, TikTok ও Alibaba-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে চীন বৈশ্বিকভাবে এই পণ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইনফ্লুয়েন্সার, রিভিউ ও কনটেন্ট মার্কেটিং-এর মাধ্যমে তারা নতুন এক ডিজিটাল ব্র্যান্ড ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে—যেখানে উৎপাদন, বিপণন ও বিতরণ—সব কিছু চীনের নিয়ন্ত্রণে।
চীন শুধু যে পণ্য তৈরি করছে তাই নয়, বরং পুরো ব্র্যান্ড ভ্যালু চেইনটি নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে। এটি এক ধরনের ইকোসিস্টেম তৈরি করছে, যেখানে উৎপাদন, ডিজাইন, বিপণন ও বিতরণ—সব কিছুই চীনের নিয়ন্ত্রণে।
যুক্তরাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসবহুল পণ্যভিত্তিক অর্থনীতি এই মুহূর্তে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববাজারে যে মূল্য-নির্ধারণ কাঠামো তৈরি করেছে, তা চীনের এই কৌশলের মাধ্যমে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
এর পাশাপাশি, চীনের এই উদ্যোগ এক ধরনের “ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসি” তৈরি করছে। যেখানে বিলাসবহুল পণ্যের উপযোগিতা শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের জন্য সীমাবদ্ধ না থেকে মধ্যবিত্তের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে। এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের এই কৌশল বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে বড় প্রভাব ফেলবে। বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর বাজার ছোট হতে পারে, কিংবা তাদের নতুনভাবে নিজেদের কৌশল সাজাতে হতে পারে।
McKinsey & Company-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের মধ্যে চীন বিশ্ব বিলাসবহুল পণ্যের বাজারের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। Statista-এর তথ্য বলছে, বিশ্ব বিলাসবহুল পণ্যের বাজারের আকার ২০২৩ সালে ছিল প্রায় ৩৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা প্রতিবছর প্রায় ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই বাজারে চীনের আধিপত্য বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে, তারা ভবিষ্যতের দাম, স্টাইল ও ক্রেতাচরিত্র নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।
শেষকথা চীনের এই মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত লড়াই কোনো সাধারণ বাণিজ্য কৌশল নয়। এটি এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার সূচনা। যেখানে পণ্যের মান নয়, ব্র্যান্ডের পারসেপশনই ছিল মূল চালিকাশক্তি—সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে চীন।
চীন দেখাচ্ছে, আধুনিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে উৎপাদনক্ষমতা, ডিজিটাল সক্ষমতা ও মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া। বিশ্ব এখন এই নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। আগামী দিনে কে জয়ী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—চীন এখন আর কেবল উৎপাদনশীল দেশ নয়, বরং এক পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক কৌশলবিদ।
তথ্যসূত্র:
-
TikTok Post by “NurNuggets”
-
Statista — Global Luxury Goods Market Overview
-
McKinsey & Company — “The State of Fashion 2023”
-
CNBC — US-China Tariff and Trade War Analysis
-
Harvard Business Review — “The Illusion of Luxury and Brand Value”
-
OECD — Global OEM Trend Data