ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সামরিক সংঘাতে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য। এই উত্তাপে কেউ আগুনে ঘি দিচ্ছে, কেউ পর্দার আড়ালে অবস্থান নিচ্ছে। আর কারো ভূমিকায় উঠে আসছে নানামুখী প্রশ্ন—যার অন্যতম হলো জর্ডান।
ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করায় অনেকে ভাবছেন, জর্ডান কি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে? এমন প্রশ্নের পেছনে আবেগ থাকলেও, বাস্তবতা অনেক জটিল এবং গভীর। আসুন ইতিহাস, ভৌগোলিক বাস্তবতা, কৌশলগত বাস্তবতা ও রাজনৈতিক নিরীক্ষায় জর্ডানের অবস্থানকে বিশ্লেষণ করি।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতেই ১৯৪৮ সালে জর্ডানসহ একাধিক আরব দেশ একযোগে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেম দখলে আনে জর্ডান। ঐ যুদ্ধে আরব দুনিয়ার সবচেয়ে সফল বাহিনী ছিল জর্ডানিয়ান আরব লিজিয়ন।
জর্ডান একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র—জনসংখ্যা মাত্র ৬০ লাখ, খনিজ সম্পদ নেই বললেই চলে। অধিকাংশ জনগণ থাকে ইসরায়েল ঘেঁষা অঞ্চলে, আর দেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল প্রায় পরিত্যক্ত। পানি সেখানে স্বর্ণের চেয়েও দামী।
তাদের সামরিক সক্ষমতা নির্ভর করে মূলত মার্কিন সহায়তার ওপর। অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে তাদের পশ্চিমাদের সাথে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধেও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে তারা। এমনকি ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপুর যুদ্ধেও সাহসী ভূমিকা ছিল জর্ডানের। এরপর নানা আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে তারা ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়।
আজকের দিনে যারা জর্ডানকে ইসরায়েলের “বন্ধু” বলে সমালোচনা করছেন, তারা যেন না ভুলে—জর্ডান তাদের দেশে থাকা প্রায় ২৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মত আশ্রয় শিবিরে আটকে রাখেনি।
বর্তমান রাণী রানিয়া নিজেই ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রভাবশালী দেশ এখনো ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব দিতে নারাজ।
ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন ও মিসাইল ছুঁড়ছে, তাদের ট্রাজেক্টরি জর্ডানের আকাশসীমা দিয়েই যায়। ফলে আত্মরক্ষার স্বার্থেই জর্ডান কিছু মিসাইল প্রতিহত করছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জর্ডানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সীমিত এবং আমেরিকার দেওয়া পুরনো প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। যদি তারা সত্যিকারে ইরানের হামলা প্রতিহত করতো, তাহলে ইসরায়েলে পৌঁছানো অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো মাঝপথেই ধ্বংস হয়ে যেত।
এছাড়া, জর্ডানের দাবি—তারা নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষার জন্য এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছে। অনেক মিসাইল জর্ডানে পড়তে পারে, এমন ভয় থেকেই এই ব্যবস্থা। তাদের ভাষ্য, “আমরা ইসরায়েলের জন্য নয়, নিজেদের জন্য ড্রোন ভূপাতিত করি।”
ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা নতুন নয়। জর্ডান বর্তমানে একটি কঠিন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। যদি তারা মুখ খুলে ইসরায়েলের বিরোধিতা করত, তাহলে হয়তো তারাই পরবর্তী গাজার রূপ পেত।
তবে রাজনৈতিকভাবে এখনো জর্ডান ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারকে সমর্থন করে এবং দুনিয়াব্যাপী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কণ্ঠ তোলে।
যুদ্ধের সময় আবেগ কাজ করে, কিন্তু জর্ডানের ভূমিকা বিচার করতে হবে ঐতিহাসিক পটভূমি, ভূরাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সামরিক সক্ষমতার নিরিখে।
জর্ডান হয়তো আজ ইসরায়েলের পাশে নেই, আবার পুরোপুরি বিপক্ষেও নেই। তারা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এক প্রান্তিক রাষ্ট্র—যাদের সিদ্ধান্তে রয়েছে রাষ্ট্রীয় চাতুর্য, ভীতিকর ভবিষ্যতের ভয় এবং অতীতের গৌরবের ছায়া।
একথা ভুলে যাওয়া যাবে না—যদি কখনো সত্যিকারের আরব ঐক্য গড়ে উঠে, তাহলে সেই সম্মিলিত প্রতিরোধে সবচেয়ে সাহসী সেনাটি জর্ডান থেকেই উঠে আসবে।