বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ১.০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার, জলবায়ু সহনশীলতা এবং রেলপথ উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে। আজ শুক্রবার (৩০ মে) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর মধ্যে টোকিওতে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর এই চুক্তি সম্পন্ন হয়।
জানা গেছে, এই সহায়তার একটি বড় অংশ ৪১৮ মিলিয়ন ডলার উন্নয়ন নীতি ঋণ হিসেবে বাংলাদেশকে দেবে জাপান। এর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে গতিশীল করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতা বাড়ানো।
এছাড়া, ৬৪১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে দেশের রেলপথ উন্নয়নের জন্য। এই অর্থ ব্যবহার করা হবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেললাইনকে ডুয়েল-গেজ ডাবল লাইনে উন্নীত করতে, যা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করে তুলবে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও জাপান তার সহায়তা অব্যাহত রেখেছে; স্কলারশিপ বাবদ ৪.২ মিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে।
এই সহায়তা চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক নোট বিনিময়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়েছে। কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে, ‘নোট বিনিময়’ একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যা দুটি সরকারের মধ্যে চুক্তি বা বোঝাপড়া নিশ্চিত করে।
টোকিওতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু দুই দেশের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন। তাঁরা একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার অভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী ইশিবা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেশ গঠন প্রচেষ্টা, বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ এবং শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রচেষ্টার প্রতি জাপানের পূর্ণ সমর্থন জানান।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে জাপানের অব্যাহত সহায়তার জন্য, বিশেষ করে বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) উদ্যোগের অধীনে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগসহ (মিডি) বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
বৈঠকে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) দ্রুত সম্পাদনের গুরুত্বের ওপর উভয় পক্ষ জোর দিয়েছে। একই সঙ্গে, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিডা) ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) ব্যবস্থার উন্নতি, প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন, ব্যাটারিচালিত সাইকেলের কারখানা স্থাপন, তথ্য সুরক্ষার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প এবং বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (বিএসইজেড) ভূমিসংক্রান্ত চুক্তিসহ একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিষয়েও উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে জাপানের অফিশিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্সের (ওএসএ) অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দ্রুত পাঁচটি প্যাট্রোল বোট সরবরাহের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ইশিবা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। অধ্যাপক ইউনূস ভাসানচরসহ এসব বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য জাপানের মানবিক সহায়তার প্রশংসা করেন। উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মিয়ানমারে একটি টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনই এই সংকটের চূড়ান্ত সমাধান।