অবশেষে গ্রেফতার হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। রাতভর অভিযান শেষে শুক্রবার (৯ মে) সকাল পৌনে ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার নিজ বাসভবন ‘চুনকা কুটির’ থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টার কিছু আগে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার নেতৃত্বাধীন পুলিশের একটি দল চুনকা কুটিরে প্রবেশ করে। তবে এই অভিযানের খবর খুব দ্রুত শহরে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই আইভীর নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ তার বাসার চারপাশে জমায়েত হতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো দেওভোগ এলাকায় উত্তেজনার বিস্তার ঘটে, যা অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আন্দোলনের রূপ নেয়।
আইভীর গ্রেফতার ঠেকাতে প্রতিরোধ
আইভীর গ্রেফতার ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সাধারণ সমর্থকরা চারপাশের রাস্তায় বাঁশ, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি রেখে সড়ক অবরোধ করে দেন। কৌশলগতভাবে ঘেরাও করে ফেলা হয় চুনকা কুটিরের চারপাশ। আশপাশের বেশ কয়েকটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হয়। ফলে রাতের শহরে সৃষ্টি হয় জনসমুদ্র, যা পুলিশি অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করে। বাসার ভেতর থেকেই আইভী তার নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বার্তা পাঠিয়ে বলেন, “তাদের (পুলিশ) বলবা আমি দিনের বেলা ছাড়া যাবো না। আমাকে আটক করতে হলে দিনের বেলা আসতে হবে।” এই বক্তব্য স্থানীয়দের মধ্যে আরও উদ্দীপনা তৈরি করে। উপস্থিত মানুষজন ঘোরতর অবস্থানে চলে যায় এবং পুলিশকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দিয়ে রাখে দীর্ঘ সময় ধরে।
পুলিশ সতর্কভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ
পুলিশের একাধিক টিম রাতভর অবস্থান করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসে পুলিশ। পরিস্থিতি যাতে সহিংসতায় রূপ না নেয়, সে জন্য পুলিশ অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়। রাত ১২টার পর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হলেও জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা চুনকা কুটিরের গেট পর্যন্তও যেতে পারেনি। ভোররাতে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা গোপন কৌশলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতৃত্ব নেন। আলোচনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে চাপ কমে এলে, ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে একটি নির্ধারিত পুলিশ ভ্যানে করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশের বক্তব্য
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, “ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলার ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে একজন জনপ্রিয় ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব। দুই মেয়াদে মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় কোন্দল এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে তিনি ক্রমশ চাপে পড়েন। তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে।
আইভী গ্রেফতারে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বড়সড় আলোড়ন
গ্রেফতারের পরেও দেওভোগ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থানীয় মানুষ এবং আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীরা এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। অনেকেই বলছেন, জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে আইভীকে কোণঠাসা করতেই এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর এই গ্রেফতার নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বড়সড় আলোড়ন তুলেছে। তার গ্রেফতারকে ঘিরে যেভাবে স্থানীয় জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তাতে স্পষ্ট যে এই ঘটনা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, সরকার ও প্রশাসন এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেয় এবং আইভীর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলোর বিচার কীভাবে পরিচালিত হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৩ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ নেয়ামুল আহসান গাজীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত থেকে ওই আদেশ দেওয়া হয়েছে।