গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২২ জন নিহতে হলে এতে পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত। কিন্তু ইসলামাবাদ শুরু থেকেই ভারতের এ অভিযোগ অস্বীকার করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশ সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ লাইনে হামলা চালিয়ে আসছিল। ৭ মে ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১টার ঘরে। দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর এবং চিরবৈরি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে কাশ্মীরের আকাশ এবং স্থলভাগে।
ভারত তার কথিত ‘সিন্দুর অভিযান’-এর নামে সুস্পষ্ট নিশানা করে মূলত ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্যকার সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি) সংলগ্ন অঞ্চলকে। এলওসির দু’পারে অবস্থিত সন্দেহভাজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর ঘাঁটি ও কাঠামো লক্ষ্য করে ২৫ মিনিট হামলা চালায় নয়াদিল্লি। প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক পাকিস্তানও চালায় পাল্টা হামলা। তাদের লক্ষ্যও ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও নিয়ন্ত্রণ রেখার সীমান্তবর্তী এলাকা। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হামলা নতুন কিছু নয়। এর আগেও দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ দুটি একাধিক বার হামলায় জড়িয়েছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেলেও হামলা থামেনি।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মূলত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। আর ভারত গঠিত হয় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।
হিন্দু মুসলিম বিভাজনের কারণে দুই দেশে ব্যাপক রক্তপাত ঘটে। এতে প্রায় এক থেকে দেড় কোটি মানুষ তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।
ওই সময়ে কাশ্মীর রাজ্যটি ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়া নিয়ে দ্বিধায় ছিল। এই অনিশ্চয়তা থেকেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সালে ভারত-পাকিস্তান এ নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের সমর্থনে ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি যুদ্ধবিরতি রেখা স্থাপন করা হয়, যা কাশ্মীরকে বিভক্ত করে। এই যুদ্ধবিরতি রেখা পরবর্তীতে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ নামে পরিচিত হয়। যা নিয়ে আজও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। উভয় দেশই কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ অংশের দাবি করে, যদিও বর্তমানে দুই দেশই কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
১৯৬৫ সালে কাশ্মীর যুদ্ধ
ভারত অবৈধভাবে কাশ্মীর দখল করেছে এই অভিযোগে ১৯৬৫ সালের আগস্টে পাকিস্তান দ্বিতীয়বার সেখানে হামলা চালায়। এতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যুদ্ধ
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিতি। ওই সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ দমাতে পাকিস্তান হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করে। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ভার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ নামকরণ হয়। ওই যুদ্ধে ৩০ লাখের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছে। নয় মাস ধরে চলা ওই যুদ্ধ হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সে সময়ে ভারতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৮৯-৯০ কাশ্মীর যুদ্ধ
১৯৮৯ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক গণবিদ্রোহ শুরু হয়, যখন বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। পরবর্তী কয়েক দশকে বহু সেনা, স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিক নিহত হন। এর জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদেরকে অর্থায়ন ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের অভিযোগ তুলে ভারত।
১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ
ওই সময়ে পাকিস্তান কারগিল পর্বতের বরফাচ্ছন্ন উচ্চভূমিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি ঘাঁটি দখল করে নেয়। তবে সংঘাত এলাকায় পারমাণবিক অস্ত্রের অংশ মোতায়েনের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর চাপের মুখে পাকিস্তান পিছু হটে। সে সময়ে ১০ সপ্তাহব্যাপী সংঘাতে অন্তত ১ হাজার মানুষ নিহত হয়।
২০১৯ সালে কাশ্মীর সংঘাত
২০১৯ সালে ভারতের পুলওয়ামাতে এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ৪০ জন নিহত হয়। ওই সময়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত থাকা ভারত যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। এতে পাকিস্তান ভারতের একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে আটক করে। পরবর্তীতে ওই সদস্যকে ফেরত দেয় পাকিস্তান।