ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ

এই যুদ্ধের শেষ কোথায়?

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ
মুহাম্মদ নূরে আলম

গত কয়েক দিন ধরে ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের খবরে পুরো বিশ্ব যেন কেঁপে উঠেছে! আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ছে, ড্রোন গর্জন করছে, আর টিভির পর্দায়, ফেসবুকের পোস্টে, খবরের কাগজের হেডলাইনে শুধু এই যুদ্ধের গল্প। কল্পনা করুন, দুই দেশ যেন দুই জেদি মুষ্টিযোদ্ধা, একে অপরের দিকে ঘুষি ছুড়ছে, আর আমরা দূর থেকে দেখছি—কী হবে এরপর? এই লড়াই কেন শুরু হলো? এটা কি শুধুই দুই দেশের ঝগড়া, নাকি এর পেছনে বড় কোনো খেলা চলছে? আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা দিনরাত বাজার, চাকরি, আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তাদের জীবনে এর কী প্রভাব পড়বে? তেলের দাম বাড়বে? জিনিসপত্রের দাম কি আরও চড়বে? চলুন, এক কাপ চা হাতে নিয়ে এই প্রতিবেদনের ভেতরে ঢুকে পড়ি, দেখি এই যুদ্ধের আসল রহস্য কী আর এর শেষ কোথায়!

যুদ্ধটা শুরু হলো কীভাবে?

গত শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ইসরায়েল তাদের “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে একটা বড় হামলা চালায় ইরানের ওপর। তারা ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র আর সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করে। এই হামলায় তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্র আর শতাধিক সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমা ফেলা হয়। পারমাণবিক কেন্দ্র মানে এমন জায়গা, যেখানে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বা শক্তি তৈরির চেষ্টা করছে বলে ইসরায়েলের সন্দেহ।

ইরানও চুপ করে বসে থাকেনি। তারা তৎক্ষণাৎ পাল্টা আক্রমণ করে। ইরান তাদের হামলার নাম দিয়েছে “অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি”। তারা ১৫০টির বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আর ১০০টির বেশি ড্রোন ছুড়েছে ইসরায়েলের হাইফা, তেল আভিভ শহরে। এই ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোনগুলো ইসরায়েলের বেশ কিছু শহর আর সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাঠানো হয়।

এই যুদ্ধ এখন শুধু দুই দেশের মধ্যে নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এর আগেও এই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, কিন্তু এবারের মতো সরাসরি যুদ্ধ আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের তাব্রিজ আর তেহরানের কাছে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর কিছু ক্ষতি হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা ইরানের আকাশে নজরদারি করার ক্ষমতা অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে। এর মানে, ইরান এখন আকাশ থেকে আসা হামলা ঠেকাতে আগের মতো শক্তিশালী নয়।

অন্যদিকে, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে গিয়ে ২৪ জন নাগরিকের প্রাণ কেড়েছে। তবে ইসরায়েলের “আইরন ডোম” নামে একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে, যেটা অনেক ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই ইসরায়েলে তেমন বড় ক্ষতি এখনো হয়নি, যতটা হয়েছে ইরানের।

কিন্তু এই যুদ্ধে শুধু সেনা বা অস্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে না। সাধারণ মানুষও মারা পড়ছে। বাড়িঘর ধ্বংস হচ্ছে। আর এই যুদ্ধ যত বাড়বে, ততই মানুষের কষ্ট বাড়বে।

কেন এই যুদ্ধ? 

ইসরায়েল আর ইরানের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে শত্রুতা চলছে। ইসরায়েল মনে করে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, যেটা তাদের জন্য বড় বিপদ। সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন,

“ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা আমাদের দেশের জন্য হুমকি। তাই আমরা এই হামলা চালিয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, ইরানের সরকারের ভেতরে অসন্তোষ বাড়ছে, আর এটা তাদের পতনের কারণ হতে পারে। 

অন্যদিকে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিশোধ নেবই।” তিনি ইসরায়েলের হামলাকে তাদের দেশের ওপর আগ্রাসন বলে মনে করছেন। ইরানের লোকেরাও তাদের সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে, কারণ তারা মনে করে এটা তাদের দেশের সম্মানের লড়াই।

অন্য দেশগুলো কী বলছে?

এই যুদ্ধে শুধু ইরান আর ইসরায়েল নয়, অন্য দেশগুলোও কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না, কিন্তু ইসরায়েলের পাশে থাকবে। বিষয়টি একটু অভিমানী বড় ভাইয়ের মতো, যে বলছে, “আমি লড়ব না, কিন্তু আমার ভাইকে কেউ মারলে আমি চুপ থাকব না।”

জি৭ নামে বড় বড় দেশগুলোর একটা দল আছে। তারা বলেছে, “ইরানের উচিত শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা করা।” কিন্তু এই হামলার পর এখন আলোচনার সম্ভাবনা খুব কম। রাশিয়া, চীন, আর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু গোষ্ঠী যেমন হিজবুল্লাহ বা হুথিরা এই যুদ্ধে নিজেদের মতো করে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর যদি ইরানপন্থী এদলগুলো এই সংঘাতে জড়িইয়ে যায়, তাহলে এই যুদ্ধ রূপ নিতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে অথবা পারমাণবিক/নিউক্লিয়ার যুদ্ধে। যা সারাবিশ্বকে কোণঠাসা করে ফেলবে। এতে বৈশ্বিক কাঠামোগত পরিবর্তের পূর্ণসম্ভাবনা রয়েছে।

এযুদ্ধে আমাদের জীবনে কী প্রভাব পড়বে?

এই যুদ্ধ শুধু ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে নয়, এটা পুরো বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলবে। কীভাবে? চলুন দেখি:

১. তেলের দাম বাড়বে: মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ হলে তেলের দাম আকাশ ছোঁয়। এরই মধ্যে খবর আছে, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ থেকে ১৭৫ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। এর ফলে আমাদের দেশে তেল, গ্যাস, আর পরিবহনের খরচ বাড়বে। বাজারে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাবে।

২. অর্থনীতিতে ঝুঁকি: বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক, যেমন আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ বা ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, এই যুদ্ধের কারণে সুদের হার বাড়াতে পারে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা আসতে পারে। আমাদের মতো দেশে চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ কমে যেতে পারে।

৩. অস্থিরতা ছড়াবে: এই যুদ্ধ যদি বড় হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি আরও বাড়বে। এটা আমাদের দেশের শ্রমিকদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যারা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যায়। তাদের চাকরি বা নিরাপত্তা নিয়ে বিপদে পড়তে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে; এই যুদ্ধ কি পারমাণবিক হবে?

এখন পর্যন্ত পারমাণবিক যুদ্ধের তেমন কোনো দৃশ্যনীয় লক্ষণ নেই। তবে, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা করেছে বলে ভয় আছে। যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের দিকে যায়, তাহলে পুরো বিশ্বের জন্য বড় বিপদ। অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরান এখনো সেই পর্যায়ে নেই। যেখানে থাকতে পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা প্রকট আঁকার ধারণ করত।

সংলাপ না সংঘর্ষ?

এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? এটা কি চলতেই থাকবে, নাকি থামবে? আমেরিকান কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ ওয়েন্ডি শেরম্যান একটা কথা বলেছেন, “শুধু যুদ্ধ করে কিছু হবে না। কূটনীতি, মানে আলোচনাই এর একমাত্র সমাধান”। এর মানে, ইরান আর ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করে টেবিলে বসতে হবে।

কিন্তু এটা এত সহজ নয়। দুই দেশই মনে করে, তারা ঠিক। তাদের নেতারা নিজেদের জনগণের কাছে শক্তিশালী দেখাতে চান। তাই আলোচনার পথে বড় বাধা। তবে বিশ্বের বড় দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বা জাতিসংঘ, যদি মধ্যস্থতা করে, তাহলে হয়তো একটা সমাধান হতে পারে।

আমরা সাধারণ মানুষ। এই যুদ্ধ আমরা থামাতে পারি না। কিন্তু আমরা জানতে পারি, বুঝতে পারি। আমরা চাই, বিশ্বে শান্তি থাকুক। যুদ্ধে কেউ জেতে না, সবাই হারে। তাই আমরা আমাদের কথা, আমাদের লেখা, বা সামাজিক মাধ্যমে শান্তির বার্তা ছড়াতে পারি।

ইরান-ইসরায়েলের এই যুদ্ধ শুধু দুই দেশের লড়াই নয়। এটা তেলের দাম, আমাদের বাজার, চাকরি, আর বিশ্ব শান্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। এটা কেবল ক্ষেপণাস্ত্র আর বোমার লড়াই নয়, এটা ক্ষমতার খেলা। তবে আমরা যদি শান্তির পক্ষে দাঁড়াই, যদি বিশ্বের নেতারা আলোচনার পথ খোঁজেন, তাহলে হয়তো এই যুদ্ধ থামবে।

শান্তি ছাড়া কোনো পথ নেই। আমরা সবাই চাই, আমাদের সন্তানরা যুদ্ধ নয়, শান্তির পৃথিবী দেখুক। তাই আসুন, আমরা শান্তির জন্য কথা বলি, শান্তির জন্য প্রার্থনা করি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

scroll to top