২০২৫ সালের জুন—মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আবারও এক ভয়াবহ মোড়। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা এখন আর কথার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ নেই, এটি রূপ নিয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘাতে। প্রতিদিনই বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি, নিহতের সংখ্যা, আর সেই সঙ্গে বাড়ছে পুরো অঞ্চলজুড়ে এক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা।
ইরান-ইসরায়েল বিরোধ নতুন নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ তৈরি হয়। ইসরায়েল বরাবরই ইরানকে একটি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখেছে, বিশেষ করে তাদের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে, ইরান মনে করে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা ছড়িয়ে রেখেছে।
এই উত্তেজনা সময়ের সাথে আরও তীব্র হয়েছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি বাতিল করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এরপরে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ, ইয়েমেন সংঘর্ষ ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ—সবই ইরান ও ইসরায়েলের পরোক্ষ সংঘাতকে তীব্রতর করেছে।
গত কয়েক দিনের মধ্যে দুই পক্ষ একে অপরের ওপর ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ২৬ জন নিহত হন। এদিকে ইরানের পাল্টা ড্রোন হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে অন্তত ২ জনে এবং আহত ১০-এর বেশি দাবি করা হচ্ছে।
তেহরান, ইসফাহান এবং মেহরাবাদ বিমানবন্দরে হামলার খবর এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে। ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের ড্রোন ও প্রজেক্টাইল প্রতিহত করছে। অন্যদিকে ইসরায়েল বলছে, তারা ইয়েমেন থেকে ছোড়া তিনটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, “তাদের (ইসরায়েল) জীবন তিক্ত করে তোলা হবে। যুদ্ধ শুরু করেছে তারা, শেষ করবে ইরান।”
এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ইসরায়েল নাকি খামেনি ও প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে লক্ষ্য করে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এই সংবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরও উত্তেজনা ছড়িয়েছে, যা নেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বহু বছর ধরে হিজবুল্লাহ, হামাস, ও হুতি বিদ্রোহীদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ চালিয়ে এলেও, বর্তমানে সংঘাত সরাসরি সামরিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু দুই দেশের লড়াই নয়—বরং পুরো অঞ্চলকেই জড়াতে পারে এক বিপজ্জনক সংকটে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অভিঘাত
মধ্যপ্রাচ্য শুধু রাজনৈতিক নয়, বৈশ্বিক জ্বালানির অন্যতম প্রধান উৎস। এই সংঘাত তেলের দাম বাড়াতে পারে, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো এই সংঘাতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া ইরানের অর্থনৈতিক-সামরিক পৃষ্ঠপোষক।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন একটি ভয়াবহ মোড়ে দাঁড়িয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ না আসে, তাহলে সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনকি তৃতীয় পক্ষগুলো জড়িয়ে পড়লে শুরু হতে পারে বড় আকারের একটি যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—উভয়পক্ষকে সংযত করা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের টেবিলে ফেরানো।
এই সংঘাত কেবল বন্দুক আর ক্ষেপণাস্ত্রের নয়, এটি হচ্ছে ভূরাজনীতির এক বিশাল জটিল খেলা—যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে একটি অঞ্চল বা পুরো বিশ্বের ভবিষ্যৎ।