২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট:

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাবনা ও সমাধান

New-Project-6-12.jpg
মুহাম্মদ নূরে আলম এম আলী

আগামী ২ জুন ২০২৫, সোমবার, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এটি এই সরকারের প্রথম বাজেট। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে এই বাজেট দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে এবং প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই বাজেটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। তবে, এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ রয়েছে, যা নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে একাধিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রথমত, মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার একটি বড় সমস্যা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে। সরকার এই হার ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে, তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি ও কাঁচামালের দামের অস্থিরতা এই লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আহরণে ঘাটতি একটি গুরুতর সমস্যা। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২১ শতাংশ কম আদায় হয়েছে। এই ঘাটতির কারণে সরকার বাজেটের আকার বাড়াতে পারছে না। ফলে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি বছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এটি স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার হ্রাস পাওয়ার ঘটনা।

তৃতীয়ত, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়া এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা সরকারের জন্য অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে সরকার বিদেশি ঋণ ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের ওপর নির্ভর করবে, তবে চড়া সুদের হারে অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ কমানোর চেষ্টা করছে।

এছাড়া, বেসরকারি বিনিয়োগের হার কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয়ে প্রত্যাশিত বৃদ্ধি না হওয়া অর্থনীতির জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এবং এডিবি চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে, যা সরকারের ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের তুলনায় কম।

সুবিধা ও সম্ভাবনা

চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা ও সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, সরকারের বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। বাজেটের আকার কমানো এবং অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এডিপির বরাদ্দ ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে, যা বিনিয়োগবান্ধব নীতির ইঙ্গিত দেয়।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হবে, যা গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে। এছাড়া, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয়ত, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি বছরের তুলনায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী, সম্পদ কর বৃদ্ধি এবং কর আদায় ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে সরাসরি করের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হলে রাজস্ব ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে। এটি সরকারের জন্য একটি সম্ভাবনা।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাজেটকে ব্যবসা-বান্ধব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য করনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ এবং কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেট বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অনেকাংশে নির্ভর করছে কাঠামোগত সংস্কার এবং কার্যকর বাস্তবায়ন কৌশলের ওপর। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের সুপারিশ এই বাজেটে প্রতিফলিত হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে, অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, কর আদায় ব্যবস্থার দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাজেট বাস্তবায়নে বাধা হতে পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপ, যেমন চাহিদা ও সরবরাহের অসংগতি রোধ করা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। এছাড়া, শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রকল্প এবং পিএম স্বনিধি প্রকল্পের সফলতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, এবং বিনিয়োগ হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পাশাপাশি, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, এবং শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। বাস্তবভিত্তিক বাজেট, কার্যকর সংস্কার, এবং সুশাসনের মাধ্যমে এই বাজেট জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। তবে, বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

 

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট, নয়াদিগন্ত, বিজনেস মিরর এবং শিরোনাম মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে সাব-এডিটর ও কনটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এনভিডিয়া ও দুবাই ওয়ান মিলিয়ন প্রমপ্টার্স থেকে জেনারেটিভ এআই ও প্রমপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সনদপ্রাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠকবান্ধব, প্রাসঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম কনটেন্ট তৈরিতে তার দক্ষতা অনন্য। ব্যবসা, প্রযুক্তি, সমাজ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখিতে তার পারদর্শিতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘স্বপ্নবাজ ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘রেঁনেসা ফাউন্ডেশন’-এর মিডিয়া প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

scroll to top