ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মুখে বিশ্ব তেলবাজার, হরমুজ বন্ধ হলে কী ঘটবে?

New-Project-30-1.jpg

হরমুজ প্রণালী। ছবি: সংগৃহীত

২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি হামলা পরিস্থিতিকে নতুন ও গুরুতর মোড় দিয়েছে। ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ অভিযানে তেহরানসহ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলার পর, পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরানও ইসরায়েলের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে। এই উত্তেজনা শুধু অঞ্চলজুড়ে নয়, বরং বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও আশঙ্কার ছায়া ফেলছে।

হরমুজ প্রণালী: জ্বালানি সরবরাহের ‘লাইফলাইন’

বিশ্লেষকদের মতে, এই উত্তেজনার সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে যাওয়া। ইরান ইতোমধ্যে সরকারি পর্যায়েই বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আইআরআইএনএন।

হরমুজ প্রণালী হলো পারস্য উপসাগরে প্রবেশের একমাত্র সমুদ্রপথ। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা (EIA)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ—প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল—এই সরু জলপথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। এই পথ বন্ধ হয়ে গেলে একদিকে যেমন বিশ্ববাজারে তেলের দাম হুহু করে বাড়বে, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হবে।

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে?

গত শুক্রবারের বিমান হামলায় ইসরায়েল ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে একটি গ্যাসক্ষেত্রসহ ১০০টির বেশি সামরিক ও অবকাঠামো স্থাপনায় টার্গেট করে। এতে অন্তত ১০৪ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীরা। প্রতিক্রিয়ায় ইরান শতাধিক ড্রোন ও ব্যালিস্টিক মিসাইল ইসরায়েলের বিভিন্ন জ্বালানি ও সামরিক স্থাপনায় নিক্ষেপ করে, যার ফলে নিহত হন অন্তত সাতজন এবং আহত হন ২০০ জনের বেশি।

সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির বিশ্লেষক সিনা তুসি আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “যদি ইসরায়েল ইরানের তেল ও গ্যাস অবকাঠামোয় আরও বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া ইরানের ‘সর্বোচ্চ মাত্রার জবাব’ হতে পারে।”

বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও অর্থনৈতিক আশঙ্কা

এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পোপ লিও শান্তির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “কোনো দেশ যেন অন্য দেশের অস্তিত্বকে হুমকিতে না ফেলে। পারমাণবিক হুমকি মুক্ত বিশ্ব গঠনের জন্য এখন সম্মানজনক সংলাপ ও ন্যায়ের প্রয়োজন।”

ওদিকে, এই উত্তেজনার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ওমানে নির্ধারিত পরমাণু আলোচনা বাতিল হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূটনৈতিক আলোচনা স্থগিত হওয়া মানেই সংঘাতের সমাধানের পথ আরও কঠিন হয়ে যাওয়া।

বিশ্ববাজার ইতোমধ্যেই এই সংকটের অভিঘাত টের পাচ্ছে। তেলের দাম বেড়ে গেছে ১২ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালী যদি সত্যিই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১২০-১৩০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে, যা ২০২২ সালের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে।

বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরকে সীমিত পরিসরে সামরিক আঘাত দিচ্ছে, তবে এই আঘাতের কেন্দ্রবিন্দু জ্বালানি অবকাঠামো হওয়ায়, এটি শুধু দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ নয়—বরং এটি হয়ে উঠছে জ্বালানি নির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থার ওপর সরাসরি হুমকি। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায়ও তেলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো কতটা কার্যকরভাবে এই পরিস্থিতি শান্ত করতে পারবে, এবং কূটনৈতিক তৎপরতা কতটা দ্রুত ও কার্যকরভাবে শুরু হতে পারে—এই দুই বিষয়ই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের দিকচিহ্ন।

Leave a Reply

scroll to top