সঠিক মসলার ব্যবহার জানলেই যে কেউ ভালো রাঁধুনি হতে পারে—শেফ জাহেদী

এক কেজি মাংসে কতটুকু মসলা লাগবে

এক কেজি মাংসে কতটুকু মসলা লাগবে তা নিয়ে শেফ জুলফিকার মো. জাহেদীর পরামর্শ
মুহাম্মদ নূরে আলম

রান্না একটি শিল্প—যেখানে প্রতিটি উপাদান, পরিমাণ ও প্রক্রিয়ার সঠিক সমন্বয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু খাবার। তবে এই শিল্পে পারদর্শী হতে হলে প্রয়োজন অভিজ্ঞতা ও সঠিক দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের খ্যাতনামা শেফ জুলফিকার মো. জাহেদী দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে রান্নার জগতে কাজ করছেন। তিনি বিভিন্ন দেশের প্রমোদতরি ও হোটেলে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে লেকশোর হাইটসের এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি তিনি বিকন একাডেমিতে রান্না শেখান এবং অনলাইনে তাঁর রান্নাবিষয়ক ভিডিওগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

শেফ জাহেদী রান্নায় মসলার সুনির্দিষ্ট পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন, যা অনুসরণ করলে খাবারের স্বাদ উন্নত হয়। নিচে বিভিন্ন রেসিপির জন্য তাঁর প্রস্তাবিত মসলা ও উপাদানের পরিমাণ দেওয়া হলো:

এক কেজি মুরগির মাংসের জন্য:

  • পেঁয়াজ: কমপক্ষে ২০০ গ্রাম
    • (গ্রেভি বাড়াতে চাইলে পেঁয়াজের পরিমাণ বাড়াতে হবে; অন্য মসলা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই)
  • আদা বাটা: ১.৫ টেবিল চামচ
  • রসুন বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • টক দই: ১০০ গ্রাম
  • লবণ: ১ টেবিল চামচ বা স্বাদমতো
    • (গ্রেভি বাড়ালে লবণও সামান্য বাড়াতে হবে)
  • চিনি: ১ চা চামচের ১/৪ ভাগ
    • (চিনি খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে)
  • শুকনা মরিচ গুঁড়া: ১ টেবিল চামচ
    • (ঝাল বেশি পছন্দ করলে পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে)
  • জিরা গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • ধনে গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • হলুদ গুঁড়া: ০.৫ টেবিল চামচ
  • এলাচ: ৪টি
  • দারচিনি: ১ ইঞ্চি টুকরা
  • লবঙ্গ: ১০টি
  • গোলমরিচ: ১০টি
  • তেজপাতা: ২টি
  • সয়াবিন তেল: ১০০ গ্রাম
    • (গ্রেভি বাড়াতে চাইলে পেঁয়াজের অনুপাতে তেল বাড়াতে হবে)

এক কেজি মাটনের জন্য:

  • পেঁয়াজ: কমপক্ষে ২০০ গ্রাম
    • (গ্রেভি বাড়াতে চাইলে পেঁয়াজের পরিমাণ বাড়াতে হবে; অন্য মসলা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই)
  • টক দই: ১৫০ গ্রাম
  • আদা বাটা: ১.৫ টেবিল চামচ
  • রসুন বাটা: ১ টেবিল চামচ
  • লবণ: ১ টেবিল চামচ বা স্বাদমতো
    • (গ্রেভি বাড়ালে লবণও সামান্য বাড়াতে হবে)
  • চিনি: ১ চা চামচের ১/৪ ভাগ
  • শুকনা মরিচ গুঁড়া: ১ টেবিল চামচ
    • (ঝাল বেশি পছন্দ করলে পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে)
  • জিরা গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • ধনে গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • হলুদ গুঁড়া: ০.৫ টেবিল চামচ
  • এলাচ: ৪টি
  • দারচিনি: ১ ইঞ্চি টুকরা
  • লবঙ্গ: ১০টি
  • গোলমরিচ: ১০টি
  • তেজপাতা: ২টি
  • সয়াবিন তেল: ১০০ গ্রাম
    • (গ্রেভি বাড়াতে চাইলে পেঁয়াজের অনুপাতে তেল বাড়াতে হবে)

 

এক কেজি গরুর মাংস ভুনার জন্য:

  • সয়াবিন তেল: ১৫০ গ্রাম
  • আদা বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • রসুন বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • শুকনা মরিচ গুঁড়া: ২ টেবিল চামচ
  • হলুদ গুঁড়া: ০.৫ টেবিল চামচ
  • জিরা গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • ধনে গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • লবণ: ১.৫ টেবিল চামচ
  • এলাচ: ৪টি
  • দারচিনি: ১ ইঞ্চি টুকরা
  • লবঙ্গ: ১০টি
  • গোলমরিচ: ১০টি
  • তেজপাতা: ২টি
  • স্বাদ বাড়াতে: জায়ফল গুঁড়া, জয়ত্রি ১টি ফুল, স্টার অ্যানিস ৩টি, কাবাব চিনি ৪টি

এক কেজি গরুর মাংসের রেজালার জন্য:

  • উপরের গরুর ভুনার উপকরণ থেকে হলুদ ও শুকনা মরিচ গুঁড়া বাদ দিতে হবে।
  • আস্ত কাঁচা মরিচ না দিয়ে বাটা কাঁচা মরিচ ব্যবহার করতে হবে।
  • কিশমিশ বাটা: ১ টেবিল চামচ
  • পোস্ত দানা বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • বাদাম বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • টক দই: ১৫০ গ্রাম

সবজি রান্নার টিপস:

  • পছন্দের সবজি কেটে নিন (রং ও রস বিকিরণ হয় এমন সবজি বাদে)।
  • পেঁয়াজ ও রসুন বড় করে কেটে নিন।
  • কাঁচা মরিচ লম্বা করে চিড়ে নিন।
  • সামান্য হলুদ ও লবণ দিয়ে ৯০% সিদ্ধ করে নিন।
  • কড়াইয়ে সামান্য তেল গরম করে ২-৩টি শুকনা মরিচ ও জিরার বাগার দিন।
  • সিদ্ধ করা সবজি দিয়ে ঢেকে দিন।
  • ভাজি না করে একটু রসা রসা রাখতে ১ কাপ পানি যোগ করুন।
  • লবণ চেখে নামিয়ে নিন।
  • সবজিতে অতিরিক্ত মসলা ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ এতে সবজির নিজস্ব স্বাদ ও গন্ধ বজায় থাকে।

ইলিশ মাছ রান্নার টিপস:

  • ইলিশ মাছ বেশি ধোবেন না; বেশি ধুলে স্বাদ কমে যায়।
  • পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে পানিতে একবার খলিয়ে নিন।
  • আদা ও রসুন ব্যবহার করবেন না; আদা দিলে তিতা লাগবে, রসুন দিলে গন্ধ হবে।
  • ৮০০ গ্রাম থেকে ১.৫ কেজি ওজনের ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু।

ইলিশের পানি ঝোল রেসিপি:

  • ইলিশ মাছ ধুয়ে লবণ, হলুদ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ও সরিষার তেল মিশিয়ে নিন।
  • সামান্য পানি দিয়ে পাত্র ঢাকনা দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিন।
  • সিদ্ধ হলে নামিয়ে পরিবেশন করুন।

শেফ জুলফিকার মো. জাহেদীর এই মসলা ও উপাদানের পরিমাপ অনুসরণ করে রান্না করলে খাবারের স্বাদ উন্নত হবে। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া এই দিকনির্দেশনাগুলো শুধু ঘরোয়া রান্নায় নয়, রেস্টুরেন্ট বা ক্যাটারিংয়ের মতো পেশাদার ক্ষেত্রেও সমানভাবে কার্যকর। বিশেষ করে যাঁরা রান্না শিখতে চান বা রান্নাকে পেশা হিসেবে নিতে চান, তাঁদের জন্য এটি হতে পারে একটি কার্যকরী গাইডলাইন।

শেফ জাহেদী রান্নায় বারবার একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলেন—”সঠিক মাপটাই আসল কৌশল”। কারণ রান্নায় কোনো উপাদান কম বা বেশি হয়ে গেলে স্বাদে ব্যাঘাত ঘটে। তিনি বলেন, “একজন দক্ষ রাঁধুনি জানেন কীভাবে একটা রান্নায় ১০০ গ্রাম তেল আরেক রান্নায় ১৫০ গ্রাম তেল ব্যবহার করতে হবে, কিংবা কখন দই কম দিয়ে আদা-রসুন বাড়াতে হবে।”

রান্নায় অতিরিক্ত মসলা বা তেল ব্যবহারে সতর্কতা:

  • বেশি মসলা মানেই স্বাদ বাড়বে—এই ধারণা ভুল। বরং অতিরিক্ত মসলায় আসল উপাদানের স্বাদ ঢাকা পড়ে যায়।
  • অতিরিক্ত তেলে রান্না করলে খাবার তৈরিতে সময়ও বেশি লাগে, আবার স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।
  • প্রতিটি রান্নার ধরন অনুযায়ী তেল-মসলার ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।

রান্নার সময় কিছু সাধারণ টিপস:

  • রান্নার শুরুতেই সব উপকরণ মেপে প্রস্তুত করে নিন। এতে সময় বাঁচে এবং পরিমাপে ভুল হয় না।
  • পেঁয়াজ ধীরে ধীরে ভাজুন, যেন রং বাদামি হয়ে আসে—তাতে স্বাদ ও ঘ্রাণ উভয়ই বাড়ে।
  • রান্নার সময় লবণ ধীরে ধীরে দিন—তাতে স্বাদ ঠিক রাখতে সুবিধা হয়।
  • দই ব্যবহারের আগে ভালোভাবে ফেটিয়ে নিন, যাতে রান্নায় ফেটে না যায়।

ভবিষ্যৎ শেফদের জন্য বার্তা:

  • “শুধু রান্না করলেই হবে না, রান্নার প্রতিটি ধাপে কেন কী ব্যবহার হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে,”—বলেছেন শেফ জাহেদী।
  • তিনি আরও বলেন, “একজন ভালো শেফ শুধু স্বাদই নয়, খাবারের রং, গন্ধ ও টেক্সচার নিয়েও সচেতন থাকেন।”
  • তরুণদের তিনি উৎসাহ দেন পেশাদার কোর্স করে রান্নার বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে।

সুন্দর ও পরিমিত রান্না কেবল স্বাদই বাড়ায় না, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্তগুলোও করে তোলে আরও আনন্দময়। শেফ জাহেদীর মতো অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শেখার মধ্য দিয়ে রান্নাকে রূপ দেওয়া যায় একধরনের শিল্পে—যেখানে প্রতিটি পদ হয়ে ওঠে আলাদা পরিচয়ের বাহক।

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট, নয়াদিগন্ত, বিজনেস মিরর এবং শিরোনাম মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে সাব-এডিটর ও কনটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এনভিডিয়া ও দুবাই ওয়ান মিলিয়ন প্রমপ্টার্স থেকে জেনারেটিভ এআই ও প্রমপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সনদপ্রাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠকবান্ধব, প্রাসঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম কনটেন্ট তৈরিতে তার দক্ষতা অনন্য। ব্যবসা, প্রযুক্তি, সমাজ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখিতে তার পারদর্শিতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘স্বপ্নবাজ ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘রেঁনেসা ফাউন্ডেশন’-এর মিডিয়া প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

scroll to top