ইন্টারনেটের কম দামে ব্যবসায়ীদের লুকানো ফাঁদ!

Illustration of hidden traps in low-cost internet packages in Bangladesh
মুহাম্মদ নূরে আলম

ইন্টারনেট এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (ISP) কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে ৫০০, ৬০০ বা ৬৫০ টাকার মতো কম দামে ১০, ১৫, ২০, এমনকি ২৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট প্যাকেজ দিচ্ছে। এই কম দামে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? তারা কি গ্রাহকদের ধোকা দিচ্ছে? যদি দিচ্ছে, তবে কীভাবে? এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে তদন্ত করব এবং সাধারণ মানুষের জন্য এই প্যাকেজগুলোর প্রকৃত মূল্য কীভাবে গণনা করা যায় তা দেখাব।

ইন্টারনেট সেবার দাম কমানোর পেছনের প্রকৃত কারণ

১. ব্যান্ডউইথের দাম কমেছে: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২৫ সালে ঘোষণা দিয়েছে যে, প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের দাম ১০০ টাকা কমানো হবে। এর আগে প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৩৬৫ টাকা, যদিও বাজারে তা ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হতো। এই দাম কমানোর ফলে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের খরচ কমেছে, ফলে তারা কম দামে উচ্চ গতির ইন্টারনেট প্যাকেজ দিতে পারছে।

২. প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি:  বাংলাদেশে ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোট ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল ১৩০.০৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে ১৪.০৪ মিলিয়ন গ্রাহক আইএসপি ও পিএসটিএন ব্যবহার করছেন। এই বিশাল বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এবং নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করতে আইএসপিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে তারা কম দামে উচ্চ গতির প্যাকেজ অফার করছে।

৩. কনটেন্ট ক্যাশিং ও খরচ সাশ্রয়:  বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ৮০-৯০% কনটেন্ট আসে গুগল, মেটা, নেটফ্লিক্স ও আকামাইয়ের মতো কোম্পানি থেকে। এই কনটেন্ট সরবরাহকারীদের ক্যাশ সিস্টেম ব্যবহার করে আইএসপিগুলো খরচ কমায়। ক্যাশ সিস্টেমের মাধ্যমে একবার ডাউনলোড করা কনটেন্ট বারবার গ্রাহকদের কাছে পাঠানো যায়, যার ফলে ব্যান্ডউইথ খরচ কমে। তবে, বিটিআরসি ২০২১ সালে ছোট আইএসপিদের কাছ থেকে গুগল ক্যাশ সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়, যা কিছু কোম্পানির খরচ বাড়িয়েছে।

৪. অবকাঠামোগত উন্নয়ন:  সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ আমদানি এবং দেশের অভ্যন্তরে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ফলে ইন্টারনেট সেবার মান উন্নত হয়েছে এবং খরচ কমেছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহৃত হচ্ছে। Early Access, যার ৫৫% ব্যবহার করছেন ১ কোটি ৪৬ লাখ ব্রডব্যান্ড গ্রাহক।

কীভাবে এত কম দামে উচ্চ গতির ইন্টারনেট দেওয়া সম্ভব?

ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে খরচ কমিয়ে এই প্যাকেজগুলো অফার করছে। তবে এর পেছনে কিছু লুকানো রহস্যও রয়েছে:

১. শেয়ারড ব্যান্ডউইথ:  বেশিরভাগ আইএসপি গ্রাহকদের মধ্যে ব্যান্ডউইথ শেয়ার করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ১০ এমবিপিএস প্যাকেজ কিনে থাকেন, তবে এই গতি আপনি একা পাচ্ছেন না। একই লাইনে একাধিক গ্রাহকের মধ্যে এই ব্যান্ডউইথ ভাগ করে দেওয়া হয়। ফলে পিক আওয়ারে (যখন অনেকে একসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার করে) গতি কমে যায়। এটি গ্রাহকদের কাছে প্রকাশ করা হয় না, যা এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

২. ফেয়ার ইউসেজ পলিসি (FUP):  কিছু আইএসপি তাদের প্যাকেজে ফেয়ার ইউসেজ পলিসি প্রয়োগ করে। এর মানে হলো, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ডাটা ব্যবহারের পর আপনার গতি কমিয়ে দেওয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০ এমবিপিএস প্যাকেজে আপনি মাসে ৩০০ জিবি ডাটা ব্যবহার করার পর গতি কমে ২ এমবিপিএস হয়ে যেতে পারে। এই শর্তগুলো প্রায়ই স্পষ্টভাবে গ্রাহকদের জানানো হয় না।

৩. কম মানের সেবা:  কিছু আইএসপি সস্তা সরঞ্জাম বা পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরচ কমায়, যা সেবার মানকে প্রভাবিত করে। ফলে গ্রাহকরা ঘন ঘন সংযোগ বিচ্ছিন্নতা, ধীর গতি বা ডাউনটাইমের সমস্যায় পড়েন।

৪. লুকানো খরচ ও অতিরিক্ত চার্জ:  কিছু কোম্পানি কম দাম দেখিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে, কিন্তু ইনস্টলেশন ফি, রাউটার খরচ, বা মাসিক সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত টাকা নেয়। এছাড়া, প্যাকেজের দামে ভ্যাট ও অন্যান্য কর যোগ হয়, যা প্রচারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় না।

৫. নেট নিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা:  কিছু আইএসপি নেট নিরপেক্ষতা লঙ্ঘন করে নির্দিষ্ট অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের গতি কমিয়ে দেয় এবং তাদের নিজস্ব সেবা বা অংশীদারদের কনটেন্টের জন্য বেশি গতি দেয়। এটি গ্রাহকদের অভিজ্ঞতাকে সীমিত করে এবং প্রতিশ্রুত সেবা থেকে তাদের বঞ্চিত করে।

গ্রাহকদের ধোকা দেওয়া হচ্ছে কি?

হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহকদের ধোকা দেওয়া হচ্ছে। কীভাবে তা নিচে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. প্রতিশ্রুত গতি না দেওয়া:  অনেক আইএসপি “আপ টু ১০ এমবিপিএস” বা “আপ টু ২০ এমবিপিএস” বলে প্রচার করে, যার মানে আপনি সর্বোচ্চ এই গতি পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে গড় গতি অনেক কম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১০ এমবিপিএস প্যাকেজে আপনি গড়ে ৪-৫ এমবিপিএস গতি পেতে পারেন।

২. লুকানো শর্তাবলী:  অনেক সময় প্যাকেজের শর্তাবলী (যেমন FUP বা ডাটা লিমিট) গ্রাহকদের স্পষ্টভাবে জানানো হয় না। ফলে গ্রাহকরা প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হন।

৩. দুর্বল গ্রাহক সেবা:  কম দামের প্যাকেজ দিয়ে গ্রাহক আকৃষ্ট করা হলেও, সেবার মান বজায় রাখতে আইএসপিগুলোর পর্যাপ্ত গ্রাহক সেবা থাকে না। ফলে সমস্যা হলে দ্রুত সমাধান পাওয়া যায় না।

৪. অতিরিক্ত চার্জ:  কিছু আইএসপি প্রাথমিকভাবে কম দাম দেখায়, কিন্তু পরে বিভিন্ন ফি ও চার্জ যোগ করে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে তারের জট সমাধানের জন্য আইএসপিগুলোকে বছরে ২৫ লাখ টাকা দিতে হয়, যা শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়।

ইন্টারনেট প্যাকেজের প্রকৃত মূল্য গণনা

একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনি কীভাবে বুঝবেন যে আপনি প্রতিশ্রুত ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন কি না? এর জন্য আমরা একটি সহজ গণনা করব।

ধাপ ১: এমবিপিএস থেকে ডাটা ডাউনলোড পরিমাণ বের করা

  • – ১ এমবিপিএস (মেগাবিট পার সেকেন্ড) = ১ মেগাবিট/সেকেন্ড
    – ১ মেগাবিট = ০.১২৫ মেগাবাইট (কারণ ১ মেগাবাইট = ৮ মেগাবিট)
    – তাহলে, ১ এমবিপিএস গতিতে ১ সেকেন্ডে ডাউনলোড হবে = ০.১২৫ মেগাবাইট
    – ১ মিনিটে (৬০ সেকেন্ড) ডাউনলোড হবে = ০.১২৫ × ৬০ = ৭.৫ মেগাবাইট
    – ১ ঘণ্টায় (৬০ মিনিট) ডাউনলোড হবে = ৭.৫ × ৬০ = ৪৫০ মেগাবাইট
    – ১ দিনে (২৪ ঘণ্টা) ডাউনলোড হবে = ৪৫০ × ২৪ = ১০,৮০০ মেগাবাইট = ১০.৮ জিবি
    – ১ মাসে (৩০ দিন) ডাউনলোড হবে = ১০.৮ × ৩০ = ৩২৪ জিবি

সুতরাং, ১ এমবিপিএস গতিতে এক মাসে সর্বোচ্চ ৩২৪ জিবি ডাটা ডাউনলোড করা সম্ভব (যদি আপনি ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট চালু রাখেন) ।

ধাপ ২: বিভিন্ন প্যাকেজের মোট ডাটা গণনা

  • ১০ এমবিপিএস: ১০ × ৩২৪ = ৩,২৪০ জিবি (৩.২৪ টেরাবাইট)
    ১৫ এমবিপিএস: ১৫ × ৩২৪ = ৪,৮৬০ জিবি (৪.৮৬ টেরাবাইট)
    ২০ এমবিপিএস: ২০ × ৩২৪ = ৬,৪৮০ জিবি (৬.৪৮ টেরাবাইট)
    ২৫ এমবিপিএস: ২৫ × ৩২৪ = ৮,১০০ জিবি (৮.১ টেরাবাইট)

ধাপ ৩: বাস্তব ডাটা ব্যবহার পরীক্ষা

বাস্তবে কেউ ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট চালু রাখে না। ধরা যাক, আপনি দিনে গড়ে ৫ ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন:

  • – ১ এমবিপিএস গতিতে ১ ঘণ্টায় ডাউনলোড = ৪৫০ মেগাবাইট
    – ৫ ঘণ্টায় ডাউনলোড = ৪৫০ × ৫ = ২,২৫০ মেগাবাইট = ২.২৫ জিবি
    – ১ মাসে ডাউনলোড = ২.২৫ × ৩০ = ৬৭.৫ জিবি

তাহলে বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য বাস্তব ডাটা ব্যবহার হবে:

  • ১০ এমবিপিএস: ১০ × ৬৭.৫ = ৬৭৫ জিবি
    ১৫ এমবিপিএস: ১৫ × ৬৭.৫ = ১,০১২.৫ জিবি
    ২০ এমবিপিএস: ২০ × ৬৭.৫ = ১,৩৫০ জিবি
    ২৫ এমবিপিএস: ২৫ × ৬৭.৫ = ১,৬৮৭.৫ জিবি

ধাপ ৪: প্রকৃত গতি যাচাই করা

আপনি যদি ১০ এমবিপিএস প্যাকেজ কিনে থাকেন, তবে আপনার প্রকৃত গতি যাচাই করতে:

  • গতি পরীক্ষা করুন: speedtest.net-এর মতো সাইট ব্যবহার করে আপনার ডাউনলোড স্পিড পরীক্ষা করুন।
    ডাটা ব্যবহার ট্র্যাক করুন: আপনার রাউটার বা ডিভাইসে ডাটা ট্র্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে দেখুন মাসে কত ডাটা ব্যবহার হচ্ছে।
    তুলনা করুন: যদি আপনি ১০ এমবিপিএস প্যাকেজে দিনে ৫ ঘণ্টা ব্যবহার করে ৬৭৫ জিবি ডাটা ব্যবহার করার কথা, কিন্তু বাস্তবে ৩০০ জিবি পান, তবে আপনি প্রতিশ্রুত গতি পাচ্ছেন না।

ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো কম দামে উচ্চ গতির প্যাকেজ দেওয়ার জন্য ব্যান্ডউইথ খরচ কমানো, কনটেন্ট ক্যাশিং, এবং প্রতিযোগিতার সুযোগ নিচ্ছে। তবে, শেয়ারড ব্যান্ডউইথ, ফেয়ার ইউসেজ পলিসি, এবং লুকানো শর্তাবলীর মাধ্যমে অনেক সময় গ্রাহকদের ধোকা দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনি উপরের গণনা ও যাচাই পদ্ধতি ব্যবহার করে নিশ্চিত করতে পারেন যে আপনি প্রতিশ্রুত সেবা পাচ্ছেন কি না। যদি সেবার মান নিয়ে সমস্যা হয়,

তবে বিটিআরসি’র নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৫ দিন সেবা না পেলে ৫০% বিল ছাড়, ১০ দিন না পেলে ২৫% বিল, এবং ১৫ দিন না পেলে পুরো বিল মওকুফের দাবি করতে পারেন।

ইন্টারনেট সেবার মান নিশ্চিত করতে আইএসপিগুলোর স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং বিটিআরসি’র কঠোর নজরদারি জরুরি। গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে।

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট, নয়াদিগন্ত, বিজনেস মিরর এবং শিরোনাম মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে সাব-এডিটর ও কনটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এনভিডিয়া ও দুবাই ওয়ান মিলিয়ন প্রমপ্টার্স থেকে জেনারেটিভ এআই ও প্রমপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সনদপ্রাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠকবান্ধব, প্রাসঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম কনটেন্ট তৈরিতে তার দক্ষতা অনন্য। ব্যবসা, প্রযুক্তি, সমাজ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখিতে তার পারদর্শিতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘স্বপ্নবাজ ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘রেঁনেসা ফাউন্ডেশন’-এর মিডিয়া প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

scroll to top