তাপপ্রবাহে রাজশাহীর বাগানে ঝরছে কাঁচা আমের স্বপ্ন

তাপপ্রবাহে রাজশাহীর বাগানে ঝরছে কাঁচা আমের স্বপ্ন
মুহাম্মাদ নূরে আলম

রাজশাহীর আমবাগানে এবার স্বপ্ন ছিল বড় রকমের। ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল দুই লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের। কিন্তু হঠাৎ করে তাপপ্রবাহ শুরু হতেই সেই স্বপ্নে ছেঁকা লাগতে শুরু করেছে। শুষ্ক বাতাস ও খরার কারণে আমের গুটি ঝরে পড়ছে অনিয়ন্ত্রিত হারে। অনেক বাগানেই ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গুটি টিকে রাখাই এখন চাষিদের কাছে এক যুদ্ধ।

রাজশাহীর বুধপাড়া, মেহেরচন্ডি, পবার হরিয়ান, শ্যামপুর ও পারিলা ইউনিয়নের বাগান ঘুরে দেখা গেছে, গাছের নিচে পড়ে থাকা শত শত আমের গুটি। মালিকেরা চোখে পানি নিয়ে বলছেন, গুটি ঝরে যাওয়ায় তাঁদের মৌসুমি আয়ের প্রধান উৎসটি ভেঙে পড়ার পথে।

পবার আমচাষি শামসুজ্জামান বলেন, “এবার মুকুল ভালোই এসেছিল। কিন্তু এখন যেভাবে গুটি ঝরছে, তাতে কিছুই বাঁচানো যাচ্ছে না। কালবৈশাখীর আগে এমন খরা হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। কারণ, বোটার রস শুকিয়ে যায়, বাতাসেই গুটি ঝরে পড়ে।”

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, “তাপপ্রবাহের কারণে আমের বোটার আঠা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে গুটি ঝরছে। এই পরিস্থিতিতে গাছের গোড়ায় সেচ ও গাছে পানি স্প্রে করাটা জরুরি। তবে প্রকৃত সমাধান একটাই—বৃষ্টি।”

তিনি জানান, গুটি ঝরার এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে চাষিদের অনেকেই মৌসুমি ব্যবসা থেকে লোকসান নিয়ে বের হয়ে যাবেন। এই অবস্থাকে আংশিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আম ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক তাঁর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, “মুকুল আর গুটি দেখে অনেক আশা ছিল। কিছু ঋণ শোধ করার পরিকল্পনাও করেছিলাম। কিন্তু এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। পানি সেচ দিয়েও বড় গাছে স্প্রে করা সম্ভব হচ্ছে না।”

দাবদাহে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে হিট স্ট্রোক!

তিনি আরও বলেন, “এই আমের মৌসুমেই পুরো বছরের আয় নির্ভর করে। গুটি না বাঁচলে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যাবে।”

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক এসএম গাউসুজ্জামান জানান, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহ এখনো চলছে। সর্বশেষ ২৪ এপ্রিল রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র একবার—১৮ এপ্রিল, মাত্র ২ দশমিক ৮ মিলিমিটার।

“আপাতত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই,” বলেন গাউসুজ্জামান। “আগামী কয়েক দিন আবহাওয়ার উন্নতি না হলে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। ফলে আমের গুটি ঝরার হারও বাড়বে।” আমচাষি মনি মিঞা বলেন, “গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছি নিয়মিত। ছোট গাছে স্প্রে করা গেলেও বড় গাছে সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিক লাগানো যাচ্ছে না, খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।”

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গুটি রক্ষায় পানি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সীমিত সম্পদের কারণে সব চাষির পক্ষে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন।

রাজশাহীর আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা এখন প্রকৃতির দিকে চেয়ে আছেন। তাদের চোখে একটাই আশা—একটু বৃষ্টি হোক, তাতে অন্তত গুটি ঝরা বন্ধ হোক। না হলে চলতি মৌসুমে রাজশাহীর আম উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নামার শঙ্কা রয়েছে।

Leave a Reply

scroll to top