বাংলাদেশের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসব—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। তবে এই দুই ঈদের আনন্দের রূপ এক নয়। রোজার ঈদের আনন্দ আসে এক মাস সংযম সাধনার পুরস্কার হয়ে, আর কোরবানির ঈদের আনন্দ আসে আত্মত্যাগ, ত্যাগ স্বীকার আর সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রতীক হয়ে। আর এই আনন্দের সুর যদি একটুও ছড়িয়ে পড়ে অদূরদর্শিতা, অসতর্কতা বা অবহেলার কারণে বেদনায়, তাহলে কোরবানির আসল শিক্ষা থেকে আমরা সরে যাই।
২০২৫ সালের ঈদুল আজহা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে, ঠিক যেমন আগের বছরগুলোতে এসেছে। তবে এবার কিছু বিষয় আমাদের ভেবে দেখতে হবে আরও গভীরভাবে। করোনা অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি হলেও, তার শিক্ষা আমাদের জন্য এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ, সংক্রমণের ভয় এখন হয়তো নেই, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি, সচেতনতা, আর মানবিকতার চর্চা—এসব এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ মানেই পশুর হাটে উপচে পড়া ভিড়, পছন্দের গরু বা খাসি খোঁজার উত্তেজনা, বাড়িতে আনা পশুকে কয়েকদিন লালনপালন করা, ঈদের দিনে কোরবানি, তারপর মাংস বণ্টন—সব মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ পারিবারিক উৎসব। বিশেষ করে শিশুরা এই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত থাকে। নতুন জামা, হাটে যাওয়া, পশু কেনার রোমাঞ্চ, আর বাড়ির উঠানে গরুর সঙ্গে বন্ধুত্ব—সব কিছুই তাদের জন্য ঈদের বিশেষ রূপ।
কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও লুকিয়ে থাকে কিছু দায়িত্ব, কিছু চিন্তার জায়গা। প্রথমত, পশু কেনা থেকে শুরু করে মাংস বিতরণ—এই প্রতিটি ধাপেই ব্যাপক জনসমাগম ঘটে। প্রতিবারই রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর থেকে লাখো মানুষ গ্রামে ছুটে যান পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ—সব পরিবহনে হুড়োহুড়ি, অতিরিক্ত ভিড়, বাড়ি ফেরার তাড়াহুড়া—সব মিলে অসতর্ক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এবারও ব্যতিক্রম হবে না, তবে ব্যতিক্রম হতে পারে আমাদের আচরণে।
আনন্দ তখনই পূর্ণ হয়, যখন তা অন্যের মুখেও হাসি ফোটায়। ঈদের শিক্ষা হলো সেই আনন্দকে ভাগ করে নেওয়া, ত্যাগের মাধ্যমে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো।
আরও পড়ুন: কুরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে ‘বিশেষ সার্ভিস’ চালু করবে বিআরটিসি
করোনার শিক্ষা ভুলে যাওয়া ঠিক নয়
২০২০ থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। মাসের পর মাস লকডাউন, অফিস-স্কুল বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে যাওয়া—এই অভিজ্ঞতা আমাদের সবার জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। একাধিক ঈদে আমরা পরিবারহীন, কোলাকুলিবিহীন, নীরব এক উৎসব দেখেছি। কারও বাড়িতে কোরবানি হয়নি, কেউ ঈদের দিনটাও কাটিয়েছেন রোগীর সেবায় বা হাসপাতালের বিছানায়। কেউ আবার প্রিয়জন হারিয়ে ঈদকেও হারিয়েছেন।
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা সেই সংকট অনেকটাই পার করেছি ঠিকই, কিন্তু মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট এখন আর অজানা কিছু নয়। সামনে ভবিষ্যতের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি যেন আবার আমাদের ঈদের আনন্দ কেড়ে না নেয়, সেই সতর্কতা থাকা প্রয়োজন।
ইসলামে ঈদের মূল শিক্ষা শুধু আনন্দ নয়, সেই আনন্দকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। কোরবানির মাধ্যমে সামর্থ্যবান মুসলমানরা তাদের ত্যাগের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী, প্রতিবেশী, আত্মীয়দের সাথে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করেন। কিন্তু আমরা যদি শুধু নিজের ঘরেই কোরবানি আর মাংস রাখি, অন্যকে ভুলে যাই—তাহলে এই কোরবানি শুধু আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মীয়ভাবে যেমন তা পূর্ণতা পায় না, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সেটি বেমানান।
২০২৫ সালে আমাদের সমাজে বৈষম্য কমেনি, বরং বিভিন্ন কারণে তা আরও বেড়েছে। কেউ কেউ করোনার পরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, ব্যবসায় লাভ করেছেন, কিন্তু অনেকেই এখনও সেই ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে পারেননি। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন, দিনমজুর ছিলেন, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ছিলেন—তাদের অনেকের জীবনে এখনও সেই ধস কাটেনি। কেউ পরিবারসহ গ্রামেই থেকে গেছেন, কেউ শহরে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে লড়াই করছেন।
এই বাস্তবতায় কোরবানির আনন্দ যেন শুধু গরুর গায়ে ওঠা দামি ঘুঙুর আর সোশ্যাল মিডিয়ার ছবি হয়ে না দাঁড়ায়। বরং আমরা যেন সত্যিকারের ভাগাভাগির মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যাই।
আরও পড়ুন: এবার মাংস প্রস্তুতকারীদের প্রশিক্ষণ দেবে ডিএনসিসি
হাটে, বাসে, কসাইখানায়—সতর্ক থাকুন
প্রতিবারই দেখা যায়, কোরবানির আগে পশুর হাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় হয়। কেউ একদিনে হাট শেষ করেন, কেউ তিন-চারবার যান পছন্দের পশু খুঁজতে। এ বছরও দেশের প্রায় ২৪০০টির বেশি কোরবানির হাট বসছে—তাতে থাকছে কোটি কোটি টাকার লেনদেন, বিপুল জনসমাগম।
এই হাটগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেমন প্রশাসনের দায়িত্ব, তেমনি স্বাস্থ্য সচেতনতা আমাদের ব্যক্তিগত দায়। মাস্ক পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা—এসব বিষয় ২০২৫ সালেও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। বিশেষ করে শিশু বা বয়স্ক কেউ হাটে গেলে, তাদের বাড়তি সাবধানতা নেওয়া উচিত।
ঈদের দিনে কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও এক বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই কোরবানির মাংস কেটে উঠানে ফেলেন, ড্রেন বা রাস্তায় রক্ত ও বর্জ্য জমে গিয়ে পরিবেশ দূষণ হয়, রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়ে। আমরা যদি ঈদের দিন বর্জ্য পরিস্কারে নিজে উদ্যোগ নিই, তাহলে শহরের পরিবেশ যেমন সুন্দর থাকবে, তেমনি ঈদের পরিচ্ছন্নতাও বজায় থাকবে।
ঈদের ভিড়ে, বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাসে, আত্মতৃপ্তির মাঝে আমরা যেন ভুলে না যাই—একটা মুহূর্তের অসতর্কতা যে কারো জীবনে আঘাত আনতে পারে। কেউ হয়তো অসুস্থ হবেন, কেউ দুর্ঘটনার শিকার, কেউ হয়তো প্রিয়জন হারাবেন। একটু বাড়তি সতর্কতা হয়তো সেই বেদনা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে।
কোরবানির ঈদ মানেই শুধু উৎসব নয়, এটি একটি পরীক্ষাও। আমরা কিভাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করি, কিভাবে মানবিকতা দেখাই, কিভাবে নিজের আনন্দ অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিই—তারও এক বিশাল মাপকাঠি এই ঈদ।
আরও পড়ুন: দোরগোড়ায় ঈদুল আজহা, কোরবানির পশু কেনার আগে যা জানা জরুরি
আজ যখন আমরা ২০২৫ সালের কোরবানির ঈদ উদযাপনে প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন আমাদের মনে রাখা উচিত—
- ঈদের আনন্দ যেন সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
- পশুর হাটে, কোরবানির সময়, পরিবহন ব্যবস্থায় সতর্কতা বজায় রাখতে হবে।
- কোরবানির মাংস শুধু আত্মীয়-স্বজন নয়, প্রতিবেশী-দরিদ্রদের মাঝেও বিতরণ করতে হবে।
- স্বাস্থ্যবিধি মানা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা—সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব।
এই ঈদে আমরা যেন এমনভাবে আনন্দ করি, যেন আগামী ঈদগুলো আরও বেশি মানুষের জন্য আনন্দ নিয়ে আসে। এমন কিছু না করি, যাতে কেউ হারিয়ে যায়, কেউ ঈদের দিন কেবল কান্নায় ভেসে যায়।
এই ঈদ হোক নিরাপত্তা, দায়িত্ববোধ আর সহমর্মিতার এক নিখুঁত চিত্র। ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক দায়িত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধের সম্মিলনে আমরা যেন সত্যিকারের কোরবানির শিক্ষা গ্রহণ করি।
আমাদের হাতে এখনো সময় আছে — চাইলে আমরা এই ঈদটিকে সবার জন্য আরও সুন্দর, আরও নিরাপদ, আরও অর্থবহ করে তুলতে পারি। আসুন, সেই সিদ্ধান্তটা আজই নেই।
এই ঈদে সবাই থাকুক ভালো, থাকুক নিরাপদ। ঈদের হাসির মাঝে যেন কারও কান্না না লুকিয়ে থাকে।
ঈদ মোবারক।
আরও পড়ুন: ইসলামে কোরবানির নিয়ত ও মানসিক প্রস্তুতি