বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র একে একে সামনে আসছে। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। রোববার (১৫ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য থেকে উঠে এসেছে এই অস্বস্তিকর চিত্র।
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বিতরণকৃত ঋণ, দুর্বল তদারকি, আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব এবং নমনীয় নীতিমালাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এতদিন যেসব ঋণ নিয়মিত হিসেবে দেখানো হতো, বাস্তবে সেগুলোর অনেকটাই ছিল অনাদায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি এবং নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ির ফলে এখন এসব ঋণ মন্দ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, ফলে প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ প্রকাশ পাচ্ছে।
এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের চিত্র আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়, অর্থাৎ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটির বেশি। এ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বহু বছরের রাজনৈতিক অনিয়ম এবং স্বার্থান্বেষী সিদ্ধান্তের ফসল, যা এখন দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুতর হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
আইএমএফের ঋণ শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ এবং সরকারি খাতে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, এ লক্ষ্য অর্জন এখনো বহু দূরের। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকেও তা ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষায়িত ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও স্বস্তিদায়ক নয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু সেই পরিমাণ এখন প্রায় ২০ গুণ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, রাজনৈতিক প্রভাবে নানা অনিয়মে জড়িত হয়ে বহু ব্যবসায়ী নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেননি। অনেকে আবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে বিদেশে।
এই পরিস্থিতি শুধুই আর্থিক খাতের দুর্বলতা নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আস্থা হারানোর আশঙ্কাও বাড়ছে। এখন সময় এসেছে বাস্তবতা মেনে নিয়ে কঠোর সংস্কার ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা গ্রহণের। তা না হলে ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থাহীনতা আরও গভীর হবে এবং তা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোকেই দুর্বল করে ফেলবে।