ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে প্রায়ই চোখে পড়ে অঙ্গহীন কিছু মানুষ, যারা জীবিকার তাগিদে ভিক্ষা করছেন। তাদের এই অবস্থার পেছনে প্রায়শই লুকিয়ে থাকে একটি ভয়াবহ রোগ—বুয়ার্জার রোগ, যিনি থ্রম্বোঅ্যাঞ্জাইটিস ওবলিটারান্স (TAO) নামেও পরিচিত। এটি একটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রদাহজনিত রোগ, যা হাত-পায়ের ছোট ও মাঝারি আকারের ধমনী এবং শিরাগুলোকে আক্রান্ত করে। এই রোগের সবচেয়ে বড় কারণ? ধূমপান। যারা ধূমপানে আসক্ত, তাদের জন্য এই রোগ একটি নীরব ঘাতক, যা অঙ্গহানির মতো মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।
বুয়ার্জার রোগ কী এবং কেন এটি ভয়ঙ্কর?
বুয়ার্জার রোগ একটি নন-অ্যাথেরোস্ক্লেরোটিক, সেগমেন্টাল প্রদাহজনিত রোগ, যা প্রধানত হাত-পায়ের ধমনী এবং শিরাগুলোতে প্রভাব ফেলে। এটি ধমনীগুলোতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, ফলে টিস্যুতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলাফল? তীব্র ব্যথা, ক্ষত, এমনকি গ্যাংগ্রিন, যা অঙ্গ কেটে ফেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৭৯ সালে কন উইনিওয়ার্টার প্রথম এই রোগের বর্ণনা দেন, এবং পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে লিও বুয়ার্জারের নামে এটির নামকরণ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এই রোগ সাধারণত ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীদের মধ্যেও এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে, কারণ নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কারা ঝুঁকিতে আছেন?
বুয়ার্জার রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো চিহ্নিত করা যায়নি, তবে তামাক ব্যবহারের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণিত। ধূমপান, বিড়ি, তামাক চিবানো—এসবই এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ইসরায়েলের আশকেনাজি ইহুদি, ভারতীয়, কোরিয়ান, এবং জাপানি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি। উত্তর ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে এটি তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ধূমপানের প্রচলন এবং সচেতনতার অভাব এই রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বুয়ার্জার রোগে আক্রান্তদের প্রায় ৮০% ধূমপায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, রোগীরা প্রাথমিক লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে রোগকে জটিল পর্যায়ে নিয়ে যান।
যে সংকেতগুলো উপেক্ষা করা যাবে না!
বুয়ার্জার রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, কিন্তু এগুলো অত্যন্ত গুরুতর। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- হাত-পায়ে তীব্র ব্যথা, বিশেষ করে হাঁটার সময় (ক্লডিকেশন)।
- আঙুলে বা পায়ের পাতায় ঝিনঝিন ভাব বা অসাড়তা।
- পায়ে বা হাতে ঠান্ডা অনুভূতি।
- ক্ষত বা আলসার, যা সহজে সারে না।
- মাইগ্রেটরি থ্রম্বোফ্লেবিটিস, অর্থাৎ শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা।
- চরম ক্ষেত্রে গ্যাংগ্রিন, যা অঙ্গ কেটে ফেলার কারণ হয়।
এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে অঙ্গহানির ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
চিকিৎসা: ধূমপান ছাড়াই একমাত্র পথ!
বুয়ার্জার রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ধূমপান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান ছেড়ে দেন, তাদের মধ্যে রোগের উন্নতি হয় এবং অঙ্গ কেটে ফেলার সম্ভাবনা ৮০% পর্যন্ত কমে যায়। কিন্তু যারা ধূমপান চালিয়ে যান, তাদের মধ্যে ৭.৬ বছরের মধ্যে ৪৩% রোগীর একটি বা একাধিক অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়।
সার্জারির ভূমিকা এই রোগে খুবই সীমিত। কারণ, রোগীর ধমনীগুলো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে বাইপাস সার্জারির জন্য উপযুক্ত ধমনী পাওয়া যায় না। এমনকি অটোজেনাস ভেইন কন্ডুইট (রোগীর নিজের শিরা) ব্যবহার করাও সম্ভব হয় না, কারণ শিরাগুলোতেও প্রদাহ ও রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা থাকে।
চিকিৎসার অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে:
- ওষুধ:রক্ত প্রবাহ উন্নত করতে অ্যাসপিরিন বা অন্যান্য অ্যান্টি-ক্লটিং ওষুধ ব্যবহার।
- থেরাপি:ইনফ্রারেড থেরাপি বা হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপি।
- জীবনযাত্রার পরিবর্তন:নিয়মিত ব্যায়াম, পায়ের যত্ন, এবং ঠান্ডা থেকে সুরক্ষা।
সচেতনতাই মুক্তির পথ
বুয়ার্জার রোগ থেকে বাঁচতে হলে ধূমপান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে, এর পাশাপাশি কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়:
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন।
- ধূমপান ছাড়তে সাহায্যকারী কাউন্সেলিং বা প্রোগ্রামে যোগদান।
- পায়ের ক্ষত বা ব্যথাকে অবহেলা না করা।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম।
বাংলাদেশে ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে, ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং দৃঢ় সংকল্পই এই রোগ থেকে মুক্তির প্রধান চাবিকাঠি।
ঢাকার ফুটপাতের নীরব ট্র্যাজেডি
ঢাকার ফুটপাতে অঙ্গহীন ভিক্ষুকদের দেখে অনেকেই সহানুভূতি প্রকাশ করেন, কিন্তু তাদের এই অবস্থার পেছনের কারণ সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। বুয়ার্জার রোগের কারণে অনেকেই তাদের হাত-পা হারান। এই রোগ শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশাও ডেকে আনে। চিকিৎসার অভাব, সচেতনতার ঘাটতি, এবং ধূমপানের প্রতি আসক্তি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
বাংলাদেশে ধূমপানের হার কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তামাকজাত দ্রব্যে উচ্চ কর আরোপ করা হয়েছে। তবে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ধূমপানবিরোধী প্রচারণা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
আজই সিদ্ধান্ত নিন
বুয়ার্জার রোগ একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এটি থেকে বাঁচতে হলে ধূমপান ছাড়তে হবে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন গ্রহণ করতে হবে। আপনি যদি ধূমপায়ী হন, তাহলে আজই সিদ্ধান্ত নিন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার একটি সিগারেট আপনার হাত-পা কেড়ে নিতে পারে—এই ভয়ঙ্কর সত্যটি মনে রাখুন।