সম্ভাবনা, শঙ্কা আর রাজনীতির মারপ্যাঁচে বাংলাদেশ

একটি মানচিত্রে বাংলাদেশ হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর করিডর সংযোগের রুট চিহ্নিত করা, সঙ্গে করিডোর নিয়ে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট আইকনগুলো যুক্ত।
মুহাম্মাদ নূরে আলম এম আলী

বাংলাদেশে করিডোর প্রসঙ্গটি সাম্প্রতিক সময়ে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে করিডোর একটি কৌশলগত ব্যবস্থা হলেও, রাজনৈতিক দলগুলো এতে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। প্রশ্ন উঠছে—এই করিডোর কি কেবল উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করবে, নাকি তৈরি করবে নতুন নিরাপত্তা হুমকি?

করিডোর কী?

‘করিডোর’ (Corridor) বলতে বোঝায় এক দেশের ভৌগোলিক সীমার ভেতর দিয়ে অন্য দেশের জন্য নির্দিষ্ট চলাচলের পথ বা ট্রানজিট রুট। এটি হতে পারে সড়ক, রেল বা নৌপথ—যার মাধ্যমে একটি দেশ তার ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বা যাতায়াতের সুবিধা পায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের জন্য ‘সিলিগুড়ি করিডোর’ (যা ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার, ভারত বহুদিন ধরে চায় বাংলাদেশ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সহজ যোগাযোগ। এ জন্যই ‘ট্রানজিট’ বা ‘করিডোর’ ইস্যুটি সামনে আসে।

বাংলাদেশে প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল—বিএনপি, বামদলগুলো এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের একটি অংশ—করিডোর ইস্যুতে সর্তক অবস্থান নেয়। এর কারণগুলো হল:

দেশের একটি বড় অংশ ভারত নিয়ে সন্দেহপ্রবণ। অতীতে নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বা তিস্তা চুক্তি না হওয়া ইত্যাদি ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এই পটভূমিতে করিডোর প্রশ্নটি ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী’ হিসেবে প্রচার করা সহজ। ‘করিডোর মানে দেশের ওপর অন্য দেশের প্রভাব বাড়ানো’—এই আবেগ অনেক দল রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মাঝামাঝি অবস্থানে কৌশলগতভাবে অবস্থান নিতে চায়। করিডোর দিলে চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হতে পারে।

নিরাপত্তা হুমকি কি তৈরি হয়?

কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে, করিডরের আওতায় যদি কোনো পক্ষ সামরিক সরঞ্জাম বা রসদ পরিবহন করে, তা হলে তা সংঘাত উসকে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত-চীন উত্তেজনার সময়ে দার্জিলিং করিডোর ঘিরেই সামরিক টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। একইরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশেও হতে পারে যদি করিডোর ব্যবহারের কোনো শর্ত ঠিকভাবে নির্ধারিত না হয়।

করিডোর হতে পারে উন্নয়নের সোপান—যদি তা স্বচ্ছ চুক্তির আওতায় হয়, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে। কিন্তু সেটি যদি হয় চাপিয়ে দেওয়া বা অসম শর্তে, তাহলে এটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। করিডোর চাই, কিন্তু সেটি হতে হবে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে।

করিডোরে বাংলাদেশের সম্ভাবনা:

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন এক ‘সোয়েট স্পট’ যেখানে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার সংযোগ ঘটানো সম্ভব। ভারত, নেপাল, ভূটান এমনকি চীনও বাংলাদেশের করিডোর ব্যবহার করতে আগ্রহী। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হতে পারে এশিয়ার এক নতুন বাণিজ্যিক গেটওয়ে।

ট্রানজিট ফি, কাস্টমস শুল্ক, বন্দরে রাজস্ব ইত্যাদির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার আয়ের সুযোগ। করিডোর ব্যবহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে লজিস্টিক হাব, ড্রাই পোর্ট, রেল ও সড়কনির্ভর শিল্প। স্থানীয় কর্মসংস্থান বাড়বে—চালক, শ্রমিক, প্রশাসন, নিরাপত্তা, কাস্টমস–সবখানেই নতুন সুযোগ।

করিডোর বাস্তবায়নের প্রয়োজনে সরকার ও বেসরকারি খাতে প্রচুর অবকাঠামো বিনিয়োগ হবে। ফলে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদীপথ ও বন্দরের সার্বিক মান উন্নত হবে। দেশীয় ব্যবহারকারীরাও এর সুফল পাবেন।

কোন ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ?

১. সার্বভৌমত্বের হুমকি: করিডরের মাধ্যমে বিদেশি যানবাহন—বিশেষ করে যদি তা হয় সামরিক বা সরকারের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত—বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলাচল করে, তাহলে তা একটি দেশের ‘সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ’ হ্রাস করতে পারে।

২. নিরাপত্তা ঝুঁকি: করিডোর দিয়ে অস্ত্র, মাদক বা চোরাচালান হতে পারে, সন্ত্রাসী সংগঠন বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চলাচল বাড়তে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত থাকায় এ ভয় অনেক বেশি।

৩. রাজনৈতিক চাপ ভারসাম্যহীনতা: বাংলাদেশ যদি শুধু ভারতের স্বার্থে করিডোর দেয়, তবে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। আবার দেশীয় রাজনীতিতেও করিডোরকে ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী’ বলে প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।

৪. অসামান্য চুক্তি: যদি করিডোর বিষয়ক চুক্তি হয় গোপন, অসম বা একতরফাভাবে—তাহলে জনগণের মধ্যে বিশ্বাস হারায়, বিরোধী দল তা দিয়ে সরকারবিরোধী প্রচার চালায় এবং ভবিষ্যতে চুক্তি কার্যকর রাখা কঠিন হয়।

মুহাম্মাদ নূরে আলম

মুহাম্মাদ নূরে আলম

মুহাম্মাদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট, নয়াদিগন্ত, বিজনেস মিরর এবং শিরোনাম মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে সাব-এডিটর ও কনটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এনভিডিয়া ও দুবাই ওয়ান মিলিয়ন প্রমপ্টার্স থেকে জেনারেটিভ এআই ও প্রমপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সনদপ্রাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠকবান্ধব, প্রাসঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম কনটেন্ট তৈরিতে তার দক্ষতা অনন্য। ব্যবসা, প্রযুক্তি, সমাজ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখিতে তার পারদর্শিতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘স্বপ্নবাজ ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘রেঁনেসা ফাউন্ডেশন’-এর মিডিয়া প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

scroll to top