সম্প্রতি সমকালসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, “বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা মুক্তিযোদ্ধা নন” কিংবা “বাতিল হলো চার শতাধিক রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি”—এমন এক প্রোপাগান্ডামূলক উপস্থাপন, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। অথচ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত মূল অধ্যাদেশটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়—এটি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের সংশ্লিষ্টতা অনুযায়ী কিছু শ্রেণিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
গেজেট অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ চার শতাধিক নেতার ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ের পরিবর্তে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, মুজিবনগর সরকারের অধীন কর্মকর্তা, প্রবাসী সংগঠক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সাংবাদিক, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়রাও এই নতুন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
প্রথমত, গেজেটের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ তাঁকেই বলা হবে, যিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন অথবা প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। এই সংজ্ঞায় নতুন করে উল্লেখ করা হয়েছে চিকিৎসা সহায়তাকারী ডাক্তার, নার্স এবং ‘বীরাঙ্গনা’দের। মূলত যারা ফ্রন্টলাইনে কিংবা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরাই এই শ্রেণিতে পড়ছেন।
অন্যদিকে, “মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তাঁদের, যাঁরা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে, মতাদর্শ ছড়াতে, সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো গড়তে এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই শ্রেণিবিন্যাস কোনোভাবেই কাউকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে অবমূল্যায়ন নয়, বরং তাঁদের অবদানকে স্বতন্ত্রভাবে স্বীকৃতি দেওয়ারই নামান্তর।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা কখনো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, বরং তাঁরা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণমানুষের স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যা স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেছে। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি অবস্থায়ও শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে থেকেছেন। তাঁর অবদান কখনোই শুধু ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দবন্ধে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।
একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন—যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামে জর্জ ওয়াশিংটন সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানই তাঁকে জাতির পিতা বানিয়েছে। বঙ্গবন্ধুও সেই অনন্য উচ্চতায় সমাসীন। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন।
এখানে সমকাল যে তথ্য উপস্থাপন করেছে, সেটি শিরোনামে অতিরঞ্জিত এবং পাঠকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির উপযোগী। “স্বীকৃতি বাতিল” কথাটির ব্যবহারই প্রথমত বিভ্রান্তিকর। গেজেটে কোথাও লেখা নেই “মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল”, বরং বলা হয়েছে, তাঁরা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এটি শ্রেণিবিন্যাস, আইনি ও নীতিগত পুনঃসংজ্ঞা।
নির্দিষ্টভাবে গেজেট অনুযায়ী ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’-এর একটি পরিমার্জনা হিসেবে এই অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। আইনটি হালনাগাদ করে সরকার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি আরও স্পষ্ট ও কার্যকর করতে চায়। উদ্দেশ্য একটাই—যে যেভাবে অবদান রেখেছেন, তাঁকে সেই ভূমিকার প্রেক্ষাপটে শ্রদ্ধা জানানো।
আসলে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি কোনো একক রূপে নয়। এটির রয়েছে বহুস্তরীয় ব্যাখ্যা। যেমন একজন রণাঙ্গনের যোদ্ধার অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি একজন কূটনীতিক বা প্রশাসনিক সংগঠকের অবদানও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা শ্রেণির মাধ্যমে সেই ভিন্নতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটাই হচ্ছে বর্তমান অধ্যাদেশের মূল ব্যাখ্যা।
তবে এটাও ঠিক, রাষ্ট্র যখন বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা এবং বহু গণপরিষদ সদস্যদের শ্রেণি পরিবর্তন করে, তখন এটি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। কারণ, ইতিহাসে তাঁদের অবস্থান শুধু আইনগত নয়, জনগণের আবেগ ও জাতীয় পরিচয়ের অংশ। তাই সরকারের উচিত ছিল বিষয়টি আরও খোলামেলা ব্যাখ্যা ও আলোচনার মাধ্যমে জাতিকে জানানো। এ ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমের দায়িত্ব ছিল অতীব সতর্কতা অবলম্বন করা। সেটিই তারা করেনি।
এখন প্রশ্ন হলো—এতদিন পর হঠাৎ কেন এই শ্রেণিবিন্যাস? আসলে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে নানা ধরনের জালিয়াতি, গেজেট দুর্নীতি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত ইত্যাদি ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশৃঙ্খলা চলছিল। এর লাগাম টানতে গিয়ে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সরকারের একটি চেষ্টা। তবে এই প্রয়াস যেন বিতর্কের জন্ম না দেয়, তার জন্য তথ্য প্রচারে আরও সতর্কতা প্রয়োজন ছিল।
শেষ কথা হলো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের অবদান কোনো ‘শ্রেণি’ বা ‘গেজেট’ দ্বারা নির্ধারিত নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের রূপকার, বাংলাদেশের স্থপতি এবং ইতিহাসের প্রধান চরিত্র। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, তিনি স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। তাই তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হলেও তা তাঁর অবদান খাটো করে না। বরং এটি একটি পৃথক শ্রেণির মাধ্যমে তাঁর কৌশলগত, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
তবে রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে—যে ব্যাখ্যা জনগণ বুঝবে না, সেটি ব্যর্থ ব্যাখ্যা। আর যে ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, সেটি ক্ষতিকর। তাই এখন সময় এসেছে এই ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ ধারণাকে সর্বজনগ্রাহ্যভাবে ব্যাখ্যা করার এবং মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলের ভুল তথ্য প্রচার রোধ করার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট