অভাব, অনিশ্চয়তা আর অজানার ঘেরাটোপে ঢাকা শৈশব পেরিয়ে একদিন স্বপ্ন ছুঁয়েছেন মো. আজাদ হোসেন। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা এক ছেলের গল্প এটি—যে ছেলেটি জীবনের প্রথম ভাগে বইয়ের মলাট চিনতেন না, অথচ এখন বাংলাদেশ প্রশাসন ক্যাডারের একজন গর্বিত কর্মকর্তা।
৪৩তম বিসিএসে প্রথমবারেই সফল আজাদ এখন বগুড়ায় সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। তাঁর জীবনচক্র যেন পাহাড়ের মতোই—উঁচু-নিচু, কঠিন, কিন্তু দৃঢ়।
‘পড়তে-লিখতে পারতাম না’—সেই শুরুটা
“ফাইভে উঠেও ঠিকঠাক পড়তে-লিখতে পারতাম না।” আজাদ বলছিলেন তাঁর শুরুর দিনগুলোর কথা। একদিন হঠাৎ স্কুল পরিদর্শনে আসা এক শিক্ষা কর্মকর্তার দৃষ্টিতে পড়ে যান তিনি। শিক্ষক সেই শিশুটির চোখে দেখতে পান সম্ভাবনার আগুন। সুযোগ করে দেন একটি ভালো স্কুলে পড়ার। তখনই যেন প্রথম আলো ফোটে আজাদের জীবনে।
অভাব ছিল, স্বপ্ন ছিল আরও বড়
আজাদের শৈশব ছিল কষ্টে মোড়া—বই কেনার টাকা ছিল না, গ্রামার বই ধার করে পড়তেন, এমনকি কখনো শুধুই পাঠ্যবই নিয়েই পরীক্ষায় বসেছেন। “আমরা জানতাম না, পড়াশোনার শক্তি কী। জানতাম না জীবনের মানে কীভাবে বদলায় বইয়ের পাতায় পাতায়,” বলেন আজাদ।
তবু থেমে যাননি। রামগড় হাইস্কুল থেকে এসএসসি, এরপর ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি। আর সেখান থেকে ঢাকার গন্তব্য—ঢাকা ডেন্টাল কলেজ।
বিসিএসের পথে একা এক সংগ্রাম
বিসিএসের যাত্রা শুরু হয় বিডিএস শেষ করার পর। ইন্টার্নশিপ চলাকালেই বইয়ে ডুবে যান তিনি। পরিবার বা আর্থিক নিরাপত্তা নয়, কেবল ইচ্ছাশক্তিই ছিল সঙ্গী। স্মার্টফোন-ল্যাপটপ বিক্রি করে দেন, যেন কোনো কিছু মনোযোগ নষ্ট না করে।
পাহাড় ছুঁয়ে এখন আকাশে পা
আজাদের সাফল্য শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জয় নয়, এটা পাহাড়ি জনপদের স্বপ্নপূরণের প্রতীক। এটা প্রমাণ যে—সুযোগ না থাকলেও, যদি ইচ্ছা থাকে, পরিশ্রম থাকলে সবই সম্ভব।
“আমার বেড়ে ওঠাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে,” বলেন আজাদ। “পাহাড় থেকে উঠে আসার এই পথ চলায় আমি শিখেছি—যদি কেউ একবার সত্যিই স্বপ্ন দেখে, তবে সে পৌঁছবেই।”
নতুনদের জন্য বার্তা
বিসিএস প্রস্তুতকারীদের উদ্দেশে আজাদের বার্তা, “পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দুর্বলতা চিহ্নিত করুন। কৌশলে এগিয়ে যান। মনে রাখবেন, প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়াই একদিন আপনাকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেবে।”
সামনে পথ আরও বড়
ভবিষ্যতে হেলথ ইকোনমিকস বা পাবলিক হেলথে মাস্টার্স করতে চান আজাদ। দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে নীতিনির্ধারক হিসেবে কাজ করাই তাঁর বড় স্বপ্ন।
আজাদের গল্প এক পাহাড়ি ছেলের—যে নীরব অবহেলাকে পেছনে ফেলে, আকাশছোঁয়া স্বপ্নের পথে এগিয়ে গেছে দৃঢ় পায়ে। তাঁর যাত্রা হাজারো তরুণের চোখে নতুন করে স্বপ্ন দেখার আলো জ্বালাবে নিঃসন্দেহে।
তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা