সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ কঠিন হয়ে উঠেছে। ভিসা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ প্রত্যাখ্যানের হার এবং নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপের ফলে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই এখন বাংলাদেশিদের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের পর্যটন শিল্প, ট্রাভেল এজেন্সি এবং এয়ারলাইনসগুলোর ওপর।
পর্যটন ও অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, এর প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশি পর্যটকদের একটি অংশের বিদেশে গিয়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ফিরে না আসা, অবৈধভাবে বসবাস করা অথবা তৃতীয় কোনো দেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে এবং ভিসানীতি কঠোর করছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক মো. তাসলিম আমিন শোভন জানান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তানের মতো দেশগুলো অতিরিক্ত সময় অবস্থানের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কেবল ভিয়েতনামেই গত দুই বছরে ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি পর্যটক নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় অবস্থান করেছেন। কিছু অসাধু চক্র সহজলভ্য ভিসা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে প্রকৃত পর্যটকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
একসময়ের জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোতেও এখন বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
ভারত: ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ভারত বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে কেবল জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য ভিসা দেওয়া হচ্ছে।
থাইল্যান্ড: বিকল্প গন্তব্য হিসেবে থাইল্যান্ড জনপ্রিয় হলেও এখন সেখানে ভিসার জন্য কমপক্ষে ৪৫ দিন আগে আবেদন করতে হচ্ছে। ভিসা প্রত্যাখ্যানের হারও অনেক বেশি এবং যারা পাচ্ছেন, তাদেরও দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগছে।
ভিয়েতনাম: একসময় ভিসামুক্ত গন্তব্য হিসেবে পরিচিত থাকলেও, পর্যটক হিসেবে গিয়ে অনেকে ফিরে না আসায় দেশটি এখন বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দিয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অন-অ্যারাইভাল ভিসাও বাতিল করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন: এই দেশগুলোতেও অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা বাতিল করা হয়েছে এবং ভিসা পেতে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগছে।
সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া: এসব দেশেও ভিসা জটিলতা বেড়েছে, আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার বেড়েছে এবং এমনকি বারবার ভ্রমণকারীদের আবেদনও বাতিল হচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই): ২০২৩ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশিদের জন্য ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। সীমিত সংখ্যক ভিসা ইস্যু হলেও তা সাধারণ পর্যটকদের নাগালের বাইরে।
ইউরোপ (শেনজেনভুক্ত দেশ): শেনজেনভুক্ত দেশগুলো গণহারে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে। ২০২৪ সালে মোট ৩৯ হাজার ৩৪৫টি আবেদনের মধ্যে ২০ হাজার ৯৫৭টি আবেদনই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যা ৫৪.৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৪২.৮ শতাংশ।
ভিসা জটিলতা বৃদ্ধির পেছনে বাংলাদেশি পাসপোর্টের ক্রমহ্রাসমান গ্রহণযোগ্যতাকেও একটি কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের সূচকে বাংলাদেশের পাসপোর্টের অবস্থান এখন ৯৫তম, যা উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশের সমতুল্য। নোমাড ক্যাপিটালিস্টের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮১তম, যেখানে ভিসামুক্ত ভ্রমণ, কর ব্যবস্থা, বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা, দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মানদণ্ডে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ৩৮।
কুয়েত এয়ারওয়েজ, মালদিভিয়ান, থাই এয়ার এশিয়া ও এয়ার এশিয়ার জিএসএ টাস গ্রুপের পরিচালক কাজী শাহ মুজাক্কের আহাম্মেদুল হক জানান, বর্তমানে বিভিন্ন গন্তব্যের ফ্লাইটগুলোতে পর্যটকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, অধিকাংশ যাত্রীই প্রবাসী। ভিসা জটিলতার কারণে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছে। এবারের ঈদে দীর্ঘ ছুটি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশিদের বিদেশে অবকাশযাপনের আগ্রহ কম ছিল, যা এই পরিস্থিতিরই প্রতিফলন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, পর্যটক ভিসায় বিদেশে গিয়ে ওভারস্টে এবং থেকে যাওয়ার প্রবণতার কারণেই বাংলাদেশিদের ভিসা জটিলতা বাড়ছে ও দেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা কমছে। তিনি জোর দেন যে, যারা বিদেশে যাবেন, তাদের শিক্ষিত, দক্ষ এবং বৈধ পথে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো ভুয়া তথ্য বা ভিসা ব্যবহার করে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ না থাকে।