মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ঢাকা বেইজিং ও অন্য নতুন অংশীদারদের দিকে ঝুঁকছে, যা অঞ্চলের জোট পুনর্গঠনে সহায়তা করছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১১ জুন ২০২৫ সালে চ্যাথাম হাউসে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১১ জুন ২০২৫ সালে চ্যাথাম হাউসে বক্তৃতা দিচ্ছেন। ছবি: লিওন নিল/গেটি ইমেজেস।

মুহাম্মদ নূরে আলম

এই সপ্তাহে চ্যাথাম হাউসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘সবার কাছে হাত বাড়াচ্ছে’।

কিন্তু সব ইঙ্গিত বলছে, তার নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটছে। এটি তার পূর্বসূরি শেখ হাসিনার ভারতকেন্দ্রিক নীতি থেকে সরে আসার সংকেত। শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন।

ইউনূস ভারতের উপর নির্ভরতা কমিয়ে বেইজিং এবং পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো অন্যান্য অঞ্চলীয় অংশীদারদের সঙ্গে নতুন কৌশলগত সম্পর্ক গড়তে চাইছেন। এটি কেবল কূটনীতি নয়; এটি বাংলাদেশের অঞ্চলীয় জোট পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার অংশ। এই পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তবে, ইউনূসের এই কৌশলের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ আগামী বছরে পরীক্ষিত হবে—নয়াদিল্লির প্রতিক্রিয়া এবং ২০২৬ সালের এপ্রিল থেকে সরে এসে বিএনপির পছন্দের দিনক্ষণ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে (১২ ফব্রুয়ারি) নির্ধারিত নির্বাচনের মাধ্যমে।

চীনের দিকে হাত বাড়ানো

ইউনূস মার্চ মাসে চীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর করেন, যা তার প্রথম উল্লেখযোগ্য দ্বিপাক্ষিক সফর। এই সফরে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং রোবোটিক্স, সাংস্কৃতিক বিনিময়, সামরিক প্রযুক্তি, এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামো নিয়ে বড় বড় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইউনূস চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অগ্রগতি থেকে শেখার আগ্রহও প্রকাশ করেন।

চীন বাংলাদেশকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। তারা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেয় এবং বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চলে চীনের হালকা উৎপাদন শিল্প স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দেয়।

দুই দেশ কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। এপ্রিলে চীন ঢাকায় বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ২,৬০০ ড্রোন দিয়ে আলোক প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যা দুই দেশের ৫০ বছরের সম্পর্ক উদযাপনের অংশ। মে মাসে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও ২৫০ জন বিনিয়োগকারী নিয়ে বাংলাদেশ সফর করেন, যা বাংলাদেশে চীনের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল।

অঞ্চলজুড়ে পরিবর্তন

যুক্তি দেওয়া যায়, শেখ হাসিনার সরকারও চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছিল। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির ৭০ শতাংশের বেশি চীন থেকে এসেছে।

তবে, হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ অঞ্চলীয় নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেছে। যৌথ সামরিক মহড়া এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান তার স্বৈরাচারী শাসন বজায় রাখতে সহায়তা করেছে। হাসিনা সার্কের মতো অঞ্চলীয় ফোরামে ভারতের পক্ষে ছিলেন, বিশেষ করে ২০১৬ সালে ইসলামাবাদ সম্মেলন বয়কট করে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।

ইউনূসের কূটনৈতিক পদক্ষেপ এই পদ্ধতিকে বদলে দিচ্ছে। তিনি বেইজিংয়ের বাইরেও সম্পর্ক গড়ছেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দশকের পর দশক ধরে চলে আসা অবিশ্বাস কাটিয়ে সম্পর্ক উন্নত করতে সম্মত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।

পাকিস্তানের আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং সরাসরি সমুদ্রপথ চালু করার পাশাপাশি ইউনূস সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ চীনের জাহাজের সঙ্গে পাকিস্তানের আমান-২৫ নৌ-মহড়ায় অংশ নেয়।

এদিকে, খবর রয়েছে যে বাংলাদেশ চীনের জে-১০ এবং জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে। এই একই বিমানগুলো পাকিস্তানের বিমানবাহিনী মে মাসে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে ব্যবহার করেছিল। পাকিস্তানের দাবি এবং অন্যান্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই চীনা যুদ্ধবিমানগুলো ভারতের বিমানের চেয়ে উন্নত ছিল।

ইউনূস এপ্রিলে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার (যা ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের কারণ হয়েছিল) তীব্র নিন্দা করেন এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঢাকার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।

কিন্তু ভারত খুশি হবে না যদি তার আরেকটি প্রতিবেশী দেশ চীনের তৈরি উন্নত যুদ্ধবিমান ক্রয় করে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতিও ভারতের পছন্দ হবে না। হাসিনার সরকার লাহোরের সঙ্গে ন্যূনতম কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখেছিল এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মতো জনসম্মুখে হাসিনা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অভিযুক্ত অপরাধের বিচারের উপর জোর দিয়েছিলেন।

চীন-ভারত সম্পর্ক কীভাবে এশিয়া ও বিশ্ব ব্যবস্থাকে গঠন করবে

ইউনূস তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে আরও দূরত্ব তৈরি করেছেন। মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘর্ষের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন দেখিয়ে নয়াদিল্লিকে ক্ষুব্ধ করেছিলেন। কিন্তু ইউনূসের অধীনে ঢাকা তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশে যৌথ প্রতিরক্ষা উৎপাদন কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানির একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

ভারতের কৌশলগত ভুল

ভারত এই বাংলাদেশী পুনর্গঠনকে উসকে দিয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন যে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন করে নয়াদিল্লি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রেখেছিল, যা শোষণ ও ক্ষোভের একটি যুগের দিকে নিয়ে গেছে। ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারত বাংলাদেশকে অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছিল। তবে, কঠোর ক্রয় শর্ত এবং তহবিল বিতরণের ধীরগতির কারণে বাংলাদেশ এটি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেনি।

এছাড়া, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিপ্লবের সময় ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এই বিদ্রোহকে ‘ইসলামপন্থী বিদ্রোহ’ হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারত তাকে আশ্রয় দেয়, যা সম্পর্ককে আরও খারাপ করে।

সীমান্তে সহিংসতা এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দ্বারা বেসামরিক নাগরিকদের জোরপূর্বক নির্বাসন সম্প্রতি বেড়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর ও চলমান উদ্বেগ। ভারত বলছে, এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার পর নিরাপত্তার কারণে এই বহিষ্কার করা হচ্ছে।

ইউনূস চীন সফরের সময় ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’—বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো—নিয়ে মন্তব্য করেন, যা নয়াদিল্লির কাছে স্পর্শকাতর ছিল। এর ফলে একটি বড় ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিল হয়, এবং ঢাকাও প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাল্টা পদক্ষেপ নেয়।

এসব কিছু বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়িয়েছে। একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশের বেশি বাংলাদেশী বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখেন, ৫৯ শতাংশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে সমর্থন করেন, কিন্তু মাত্র ১১ শতাংশ নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের পক্ষে।

বাংলাদেশের যে কোনো নতুন নির্বাচিত সরকারকে আরও অশান্তি এড়াতে এই জনমত বিবেচনা করতে হবে।

অঞ্চলের পুতুল থেকে অঞ্চলের খেলোয়াড়

ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশ ভারতের প্রান্তিক রাষ্ট্র হওয়ার পরিবর্তে নিজের শর্তে বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায়। চীন, তুরস্ক, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল অবকাঠামোতে সহযোগিতার মাধ্যমে কৌশলগত বৈচিত্র্য অর্জন করছে।

এর লক্ষ্য উন্নয়ন এবং বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন—চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা। এই বহুমুখী কৌশল যদি টিকে থাকে, তবে বাংলাদেশ অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া এই নতুন অঞ্চলীয় ব্যবস্থা টেকসই হবে নাকি অস্থির হবে তা নির্ধারণ করবে। বেইজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক ঝুঁকিমুক্ত নয়।

ইউনূসের কৌশলের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ আগামী বছরে পরীক্ষিত হবে—নয়াদিল্লির প্রতিক্রিয়া এবং ২০২৬ সালের এপ্রিলে নির্ধারিত নির্বাচনের মাধ্যমে।

ইউনূসের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রোফাইল বাড়িয়েছে। কিন্তু চীনের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা—বিশেষ করে এআই এবং সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে—তথ্য গোপনীয়তা এবং বাংলাদেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ তৈরি করে।

দুর্নীতি এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধানে দ্রুত প্রযুক্তিগত সমাধান চালু করতে গিয়ে তথ্য নৈতিকতার উপর জনসাধারণের আলোচনার অভাব দেখা যাচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে উদ্ভাবনের দৌড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ছে।

এছাড়া, বাংলাদেশ যদি সুষম ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে চীনের অঞ্চলীয় কৌশলে একটি প্রান্তিক ভূমিকায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এখন পর্যন্ত ইউনূস সরকার এই জটিলতাগুলো নিয়ে চলার ক্ষমতা দেখিয়েছে এবং জনগণের উল্লেখযোগ্য আস্থা অর্জন করেছে। তৃণমূল পর্যায়ে তার ক্ষমতায় থাকার আহ্বান এটি প্রমাণ করে।

তবে, নির্বাচন সামনে রেখে ভবিষ্যৎ সরকারকে এই কৌশলগত স্পষ্টতা ও স্বায়ত্তশাসনের মান বজায় রাখতে হবে। নইলে বাংলাদেশ আবারও চীন বা অন্য কোনো বড় শক্তির অধীনস্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

প্রতিবেদন ও অনুবাদের তথ্যসূত্র: চ্যাথাম হাউস
মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম

মুহাম্মদ নূরে আলম (Muhammad Noora Alam) একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

scroll to top