বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত এই গানটি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু এর ঐতিহাসিক পটভূমি, রচনার উদ্দেশ্য, এবং বাংলাদেশের জনগণের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই কলামে যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করা হবে, কেন এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে উপযুক্ত নয় এবং কেন এটি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন।
১. বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গানটির উৎপত্তি
‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত হয়, যখন ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে, যার রাজধানী ছিল ঢাকা। এই বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, প্রশাসন, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কলকাতার হিন্দু ভদ্রলোক সমাজ, যারা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কলকাতার নিয়ন্ত্রণে ছিল, এই ভাগাভাগির বিরোধিতা করে। তাদের মতে, বঙ্গভঙ্গ বাংলার ঐক্য নষ্ট করছে, যদিও এই ‘ঐক্য’ মূলত হিন্দু জমিদার ও ভদ্রলোক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য ছিল।
রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনের সমর্থনে ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনা করেন এবং ২৫ আগস্ট ১৯০৫-এ কলকাতার টাউন হলে এটি প্রথম পরিবেশন করা হয়। এই গানটি বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে, যা পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। ফলে, এই গানটি বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা বা স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে কলকাতার জমিদার শ্রেণির শোকগাথা হিসেবে কাজ করেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে এর উপযুক্ততার প্রশ্ন তুলে।
২. গানটির সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত অসামঞ্জস্য
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে এমন একটি গান প্রয়োজন, যা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, জনগণের ত্যাগ, এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে প্রতিফলিত করে। কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’ এই মানদণ্ডে খাপ খায় না। এই গানটি একটি রোমান্টিক ও আবেগপ্রবণ বাংলার চিত্র তুলে ধরে, যা কলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এতে পূর্ববঙ্গের মুসলিম চাষাভুষা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সংগ্রাম, বা আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন নেই।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, তা ছিল পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’ এই সংগ্রামের কোনো উল্লেখ বহন করে না। এটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত, যা মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। ফলে, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতীয় আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমন একটি গান, যা বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম ও বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব করে না, তা জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
৩. ইসলামোফোবিয়া ও বঙ্গদর্শন পত্রিকার ভূমিকা
‘আমার সোনার বাংলা’ প্রথম প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। এই পত্রিকাটি ছিল হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামোফোবিক আদর্শের প্রচারক। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস, যেখানে ‘বন্দে মাতরম’ গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে ভরা। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক লেখায় মুসলিম সম্প্রদায়কে অবমাননা করা হতো, যা কলকাতার হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।
রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকায় ‘আমার সোনার বাংলা’ প্রকাশ করেন, যা তার নিজের আদর্শিক প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী জীবনে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে আসেন, তবুও এই গানটির প্রকাশের সময় তিনি কলকাতার হিন্দু জমিদারদের স্বার্থের পক্ষে ছিলেন। এই পত্রিকার ইসলামোফোবিক ইতিহাস এবং এর সঙ্গে গানটির সংযোগ বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য এটিকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। একটি জাতীয় সংগীত এমন হওয়া উচিত, যা সকল সম্প্রদায়ের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের সঙ্গে যুক্ত নয়।
৪. জাতীয় সংগীত নির্বাচনের প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ইকবাল হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের একটি ছোট দল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত বা কোনো গণভোটের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটির প্রস্তাব উঠলেও তা বাতিল করা হয়, কারণ এতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ছিল না এবং এর রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
এই সিদ্ধান্তে ভারতের প্রভাবের অভিযোগও উঠেছে। সিরাজুল আলম খান, যিনি কলকাতার চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন, ভারতের সঙ্গে পূর্ববঙ্গকে যুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ‘আমার সোনার বাংলা’ নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে দেখা যায়, যা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতা অপরিহার্য, যা এই ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল।
৫. বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে অমিল
বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, এবং শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ এই পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই গানটি কলকাতার ভদ্রলোক সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত, যারা পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কখনোই ‘বাঙালি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং, তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রজা বা নিম্নশ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণ যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, তা ছিল নিজস্ব পরিচয় ও স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’ এই স্বাধীনতার চেতনাকে প্রতিফলিত করে না। বরং, এটি একটি অখণ্ড বাংলার কথা বলে, যা কলকাতার জমিদার শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় সংগীত হিসেবে এমন একটি গান প্রয়োজন, যা তাদের সংগ্রাম, স্বাধীনতা, এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সঠিকভাবে প্রকাশ করে।
৬. নতুন জাতীয় সংগীতের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে এমন একটি গান প্রয়োজন, যা দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জনগণের ত্যাগ, এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। এই গানটি সকল সম্প্রদায়ের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে হবে এবং কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে না। ‘আমার সোনার বাংলা’ এই শর্ত পূরণ করে না, কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত, যা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল।
নতুন জাতীয় সংগীত নির্বাচনের জন্য একটি গণভোট বা জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রয়োজন। এই গানটি এমন হওয়া উচিত, যা বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের কথা বলে, তাদের সংগ্রামের ইতিহাসকে সম্মান করে, এবং ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদ প্রকাশ করে। এটি শুধু গান বদলের লড়াই নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব ইতিহাস ও পরিচয় পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।
‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এটি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত, যা পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া, এর সঙ্গে ইসলামোফোবিক পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’ এবং অস্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংযোগ এটিকে আরও বিতর্কিত করে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এমন একটি জাতীয় সংগীত প্রয়োজন, যা তাদের সংগ্রাম, ত্যাগ, এবং স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। এই লড়াই শুধু গান বদলের নয়, বরং নিজেদের ইতিহাস ও পরিচয় পুনরুদ্ধারের। এখনই সময় এসেছে নতুন জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট